শেখ আবু তালেব: দেশের পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন বিদেশিরা। নতুন বিনিয়োগও আসছে না। চলতি অর্থবছরে ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) নেট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র এক কোটি ৪০ লাখ ডলার। অথচ গত অর্থবছরের (২০১৮-১৯) আলোচিত সময়ে দেশের পুঁজিবাজারে নেট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল এর দশগুণের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
বিদেশি বিনিয়োগ কমে আসার পেছনে করোনাভাইরাস ও অর্থনীতির করুণ চিত্রকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, নীতিনির্ধারকদের বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ না করার মানসিকতা না থাকাকে এর জন্য দায়ী করছেন।
সূত্র জানিয়েছে, শুধু বিনিয়োগ প্রত্যাহারই নয়, লেনদেনও কমিয়ে আনছেন তারা। অনেকেই শেয়ার বিক্রি করছেন বেশি। এজন্য দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে দেশের পুঁজিবাজারে নিট বিদেশি বিনিয়োগের এসেছে মাত্র এক কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ হিসাবে গত অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরের আলোচিত সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে দশ ভাগের এক ভাগের বা ১০ শতাংশেরও কম।
এদিকে দুই মাস বন্ধ হওয়ার পরে গত ৩১ মে চালু হয় দেশের পুঁজিবাজার। লেনদেন শুরুর দ্বিতীয় দিন থেকেই সূচকের পতন ঘটতে থাকে। পাশাপাশি কমে আসে লেনদেন। সর্বশেষ কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছে মাত্র ৪২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এই লেনদেন গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। এ অবস্থায় চলতি মাসে আর বিদেশি বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনাও নেই। বরং অনেকে আরও শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লেনদেন কমে আসার জন্য করোনাভাইরাসও (কভিড-১৯) কম দায়ী নয়। কিন্তু শুধু ভাইরাস আতঙ্কে এত কম আকারের লেনদেনকে বিশ্বাস করছেন না বিশ্লেষকরা। তারা দায়ী করছেন বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরও। করোনাভাইরাসের সময়েও উৎপাদনশীল খাতের বেশ কিছু কোম্পানি ভালো মুনাফা করছে।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, মূলত আস্থাহীনতার কারণেই বিদেশিরা বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন। গত দুই মাসের বেশি সময় দেশের পুঁজিবাজার বন্ধ ছিল। অন্যান্য দেশ এই সময়ে তাদের পুঁজিবাজারকে চালু রেখেছিল। তবে আমাদের দেশে পুঁজিবাজার বন্ধ রাখার বিষয়টিও তারা ভালো চোখে দেখেনি। এ নিয়ে তারা বিবৃতিও দিয়েছিল। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে তাদের আকৃষ্ট করতে না পারলে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ আরও কমে যেতে পারে।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে এর মুনাফা তুলে নিতে পারেন বিদেশিরা। তবে কোম্পানির প্রি-আইপিওতে বিনিয়োগ করলে তাতে নির্ধারিত সময়ের জন্য লকইন থাকে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তারা ওইসব শেয়ার বিক্রি করতে পারেন না।
বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে সুসময় ছিল ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে তাদের বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় ছিল। একটানা সাত বছরে বিদেশিরা আট হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা নিট বিনিয়োগ করেছেন।
এরপর থেকেই বিদেশিদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে দেখা যাচ্ছে। মূলত ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিদেশি বিনিয়োগ কমে আসছিল। নির্বাচনী বছরে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ তারা প্রত্যাহর করে নেন।
যদিও নির্বাচন শেষে গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ফের নতুন বিনিয়োগ করেন তারা। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি শেষের দিকে। বাজারের ক্রম পতনের ধারায় তারা বিনিয়োগ তুলে নেন। ফলে গত বছরের শেষ নাগাদ এক সময়ে নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক হয়ে পড়েছিল। শুধু নতুন বিনিয়োগে ঋণাত্মক নয়, বিনিয়োগ প্রত্যাহারও করে নেন তারা। এ সময় আগের বছরের ৬০০ কোটির সঙ্গে মিলিয়ে আরও প্রায় ২০ কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নেন তারা।
জানা গেছে, আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে একটি প্রথা চলে আসছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে দেশি বিনিয়োগও বৃদ্ধি পায়। সঙ্গে বাড়ে লেনদেনের আকার। আবার বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি শুরু করলে পুঁজিবাজারে বিক্রয় চাপ বৃদ্ধি পায়। যদিও বর্তমানে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের পুঁজিবাজারের অবস্থান তুলনামূলক নাজুক। তাই দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ধরে রাখতে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এখনই ভাবা প্রয়োজন।