ইসমাইল আলী: বেসরকারি খাতে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১১ সালের দিকে। সে সময় গ্যাস ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয় সরকার। ওই সময় অনুমোদন পায় সামিট মেঘনাঘাট ৩৩৫ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। গ্যাস সংকটে প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রটি চার বছর ডিজেলে চালানো হয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ত অনেক বেশি।
দেশে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আসার পর কেন্দ্রটি গ্যাসে চালানো শুরু হয়। তবে গ্যাস সংকটে প্রায়ই বসিয়ে রাখতে হয় কেন্দ্রটি। এতে গচ্চা যায় মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ।
সূত্রমতে, গ্যাস সংকটে চলতি বছর প্রায় চার মাস বন্ধ রাখতে হয়েছে সামিট মেঘনাঘাট ৩৩৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি। এর মধ্যে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাস টানা বন্ধ ছিল কেন্দ্রটি। মাঝে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত চালানো হলেও তা ছিল অনিয়মিত। মাত্র কয়েক দিন ৩৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা হয়েছে। বাকিটা সময় ১০০ থেকে ২১০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয় কেন্দ্রটি।
জুন মাসে কেন্দ্রটিতে মাত্র চার দিন পুরো ক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এর পর থেকে সক্ষমতার একটি অংশ বসিয়ে রাখতে হয়। আর গত ৩ জুলাই থেকে টানা বন্ধ রয়েছে কেন্দ্রটি। ফলে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় দুই মাস বন্ধ রয়েছে। আর বসিয়ে রেখেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য প্রতি মাসে প্রায় ৪০ কোটি টাকা করে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। ফলে চার মাসে পিডিবির গচ্চা গেছে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা।
যদিও এ পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে, তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় দৈনিক এক হাজার ৩২০ এমএমসিএফ গ্যাস দরকার। কিন্তু পেট্রোবাংলা থেকে দেয়া হয় ৯০০ থেকে এক হাজার এমএমসিএফ গ্যাস। কোনো কোনোদিন তার চেয়েও কম পাওয়া যায়। এজন্য বাধ্য হয়ে সামিটের কেন্দ্রটিসহ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তবে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হলে কেন্দ্রটি আবার চালু করা হবে।
তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরও সামিট মেঘনাঘাট কেন্দ্রটি প্রায় অর্ধেক সময় বন্ধ থাকে। ওই অর্থবছর কেন্দ্রটি চালানো হয়েছে মাত্র ৫২ শতাংশ সময়। আর গত অর্থবছর কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে প্রায় ৪৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ২২০ কোটি টাকাই গচ্চা গেছে। প্রায় অর্ধেক সময় বসে থাকা কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও পড়ে বেশি।
গত অর্থবছর সামিট মেঘনাঘাট কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়ে চার টাকা ১৮ পয়সা। যদিও পূর্ণ ক্ষমতার ব্যবহার হলে এ ব্যয় দুই টাকায় নেমে আসত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছর কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৪৬৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ওই অর্থবছর কেন্দ্রটির সক্ষমতার ব্যবহার হয় ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ ক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় ২০০ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে গড়ে চার টাকা ২০ পয়সা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৪৫৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ওই অর্থবছর কেন্দ্রটির সক্ষমতার ব্যবহার হয় ৫২ শতাংশ। এতে ১৯০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গচ্চা গেছে। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে গড়ে পাঁচ টাকার বেশি।
এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে সামিট মেঘনাঘাট কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। এর আগে কেন্দ্রটি ডিজেলে চলত। ওই অর্থবছর ডিজেল দিয়ে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় মাত্র ৯ শতাংশ সময়। আর কেন্দ্রটি গ্যাসে চলে ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছর কেন্দ্রটির সার্বিকভাবে সক্ষমতার মাত্র ৩৮ শতাংশ ব্যয় হয়। সে বছর কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় ৫৯৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছর পিডিবির গচ্চা গেছে প্রায় ৩৭০ কোটি টাকা।
২০১৮-১৯ অর্থবছর সামিট মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ডিজেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ৩১ টাকা ৪০ পয়সা। আর গ্যাসে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় পড়ে চার টাকা আট পয়সা। অর্থাৎ গ্যাসের তুলনায় ডিজেলে উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ে ২৭ টাকা ৩২ পয়সা বা ৬৬৯ দশমিক ৬১ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্যসচালিত বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে পাঁচটি কেন্দ্র দক্ষ। এর মধ্যে একটি সামিট মেঘনাঘাট কেন্দ্রটি। তবে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় প্রায় সময়ই এটি বন্ধ রাখতে হয়। এছাড়া চালুর পর প্রায় চার বছর ডিজেলে চালাতে হয়েছে কেন্দ্রটি। সে সময় প্রায়ই এটি বন্ধ রাখা হতো, কারণ ডিজেলে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি পড়ে।
উল্লেখ্য, সামিট মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১৪ সালে ২৯ মে উৎপাদন শুরু করে। সে সময় সিম্পল সাইকেলে পরিচালিত হতো কেন্দ্রটি। ২০১৫ সালের ১ জুন কম্বাইন্ড সাইকেল ব্যবস্থা চালু করা হয়। তবে প্রতি বছরই কেন্দ্রটি বন্ধ রেখে মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় পিডিবিকে। এছাড়া শুরুর চার বছর গ্যাসের পরিবর্তে ডিজেলে উৎপাদনের ফলে পিডিবির প্রায় ছয় হাজার ১৮৭ কোটি টাকা গচ্চা গেছে।