Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 9:41 am

চলতি মৌসুমে না কমার সম্ভাবনা, সরু চালের দামও সর্বোচ্চ

নাজমুল হুসাইন: মোটা চালের দামে নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস উঠেছে গত বছর থেকেই। এখন খুচরা বাজারে মোটা চাল কিনতে গুনতে হয় ৪২ থেকে ৪৪ টাকা, যা সর্বকালের সর্বোচ্চ। তবে এখন শুধু মোটাই নয়, সরু চালের দামও অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখী। সরকারি একাধিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরু চালের দামও এখন বিগত সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ।

কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্য অনুয়ায়ী, ২০১২ সালেও রাজধানীতে প্রতি কেজি সরু চালের গড় পাইকারি দাম ছিল ৩৮ দশমিক ৮৭ টাকা। আর বর্তমানে সরু চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি গড়ে প্রায় ৫২ টাকার ওপরে। এদিকে ২০১৩ সালে দেশে প্রতি কেজি সরু চালের গড় দাম ছিল ৪১ দশমিক ৯৬ টাকা, পরের বছর ২০১৪ সালে ৪৫ দশমিক ৬৯ টাকা, ২০১৫ সালে ৪৩ দশমিক শূন্য সাত টাকা ও গত বছর ২০১৬ সালে ৪৩ দশমিক শূন্য নয় টাকা। বর্তমানে গতকাল রাজধানীর বাজারে পাইকারি সরু চাল বিক্রি হয়েছে ৪৯ টাকা থেকে ৫৪ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ গড় দাম দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৫২ টাকা।

এদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০১০-১১ সালে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খুচরায় প্রতি কেজি সরু চাল বিক্রি হয়েছে ৪৭ দশমিক ২৯ টাকা, যা ক্রমাগত বেড়ে গত বছর দাঁড়ায় ৫৩ দশমিক ৫২ পয়সা। আর এখন বিভিন্ন বাজারে সরু চালের খুচরা গড়মূল্য ৫৫ টাকার ওপরে।

দেশে চলতি রোরো মৌসুমের চাল বাজারে আসতে শুরু করেছে। এর মধ্যে গতকাল কয়েকটি বাজারে নতুন সরু মিনিকেট চাল দেখা গেছে। তবে তার কোনো প্রভাবই পড়েনি চালের দামে। নতুন চালও আগের মতোই বর্ধিত দামে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এখন প্রতি কেজি মিনিকেট চাল কিনতে গুনতে হচ্ছে ৫৪ টাকা থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। আরও সরু আরেক পদের ভালোমানের নাজির চালের দাম ৬০ টাকা পেরিয়েছে।

এমতাবস্থায় ব্যবসায়ীরা বলছে, রাজধানীর বাজারে সরু চাল বলতে মিনিকেট ও নাজিরের চাহিদাই বেশি। তবে এ মৌসুমে শুধু নতুন মিনিকেট চাল বাজারে আসবে। আর নাজির আবাদ হয় আমন মৌসুমে। চলতি বোরো মৌসুমে বাকি পদের চালের বেশিরভাগ মোটা। বিগত সময়ে চালের দাম বেশি থাকায় ও গত আমন মৌসুমে আবাদ কাক্সিক্ষত না হওয়ায় এখন দেশে নাজির চালেরও সংকট রয়েছে, যা আসন্ন মিনিকেট দিয়ে পূরণ হবে না। এতে সরু চালের দাম কমার সম্ভবনা খুবই কম।

বছরের এ সময়ে নতুন বোরো মৌসুমের চালের সরবরাহ শুরু হয়। তবে এ বছর শীত বিলম্বিত হওয়া এবং গত মাসে হঠাৎ অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে চালের সার্বিক উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। দেশে ভারতীয় চালের আমদানি প্রায় বন্ধ। সরকার কিছু চালের আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সরকারেই মজুদ স্বল্পতা পূরণে তা ব্যয় হবে। এতে আগামী দিনে চালের সরবরাহ কিছু কম হওয়ার তথ্যের মনস্তাত্ত্বিকভাবে গত কয়েক সপ্তাহে বাজারে হু-হু করে সব ধরনের চালের দাম বাড়ে। এখন মৌসুম শুরু হলেও তা কমার কোনো লক্ষণ নেই।

এদিকে সরকারের আরেক সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্যে, গত এক বছরের ব্যবধানে খুচরা বাজারে সরু চালের দাম বেড়েছে সাত দশমিক সাত শতাংশ। এরমধ্যে সাধারণ মানের মিনিকেট বা নাজিরের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর উত্তম মানের এসব চালের দাম চার দশমিক ৮৫ শতাংশ বেড়েছে।

এখন সরু চালের দাম কমার সম্ভাবনা কতটুকু জানতে চাইলে নওগাঁর দীর্ঘদিনের পুরোনো ব্যবসায়ী ও ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহা শেয়ার বিজকে বলেন, এখনও চালের দাম কমার কোনোই সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। এ বছর ধানের দাম প্রচুর। গতকাল এখানে প্রতি মণ ধান প্রায় হাজার টাকায় উঠেছে, যা কয়েক বছরের রেকর্ড।

তিনি বলেন, আমার মনে হয় আমদানি ব্যতীত এবার চালের দাম কমানো সম্ভব হবে না। ব্যবসায়ীদের কম শুল্কে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর না হলে সরকারকে মাঠপর্যায় থেকে কঠিন মনিটরিং করতে হবে।

বর্তমান সেখানকার সরু চালের বাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গতকাল নওগাঁর বিভিন্ন মোকামে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৪০০ টাকায়। আর সাধারণ মানের চাল বাংলা মণে (প্রায় ৩৮ কেজি) এক হাজার ৭২০ টাকায়। অর্থাৎ ৪৬ টাকা থেকে ৫০ টাকায়  মোকামেই চাল পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। এত দাম কখনোই ছিল না। আর নতুন চাল আসায় কোনো প্রভাবই পড়েনি এসব বাজারে।

একই ধরনের শঙ্কার কথা জানিয়ে রাজধানীর পাইকারি বাজার বাবুবাজার-বাদামতলীর চালের আড়তের শিল্পী রাইস এজেন্সির মালিক কাওসার রহমান বলেন, এ  মৌসুমে ২৫ শতাংশ চালের সরবরাহ আসতো। তবে বৃষ্টি ও বন্যায় এবারও সরবরাহ অনেক কম হবে। সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে এবার চাল যাবে। কারণ সেসব এলাকায় ফলন নষ্ট হয়েছে। এছাড়া হাওরে যে পরিমাণ ধান নষ্ট হলো, তাতেও সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে আপাতত চালের দাম কমার সম্ভাবনা খুবই কম। বিশেষ করে চিকন চালে তা শূন্য।

সবধরনের চালের দাম সর্বোচ্চ, যার বহুমুখী প্রভাব পড়ছে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের ওপর। দেশের নি¤œবিত্তদের যেমন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে মধ্যবিত্তরাও এখন পরিবারের অন্যান্য ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা বলছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা। এতে ভোগ কমিয়ে দেয় ৭৩ দশমিক আট শতাংশ হতদরিদ্র ও ৬৬ শতাংশ দরিদ্র পরিবার। এর বাইরে মধ্যবিত্তরাও খাদ্য মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হন। এ শ্রেণির প্রায় ২৪ শতাংশ পরিবার চালের ভোগ কমাতে বাধ্য হয়। এছাড়া অন্যান্য ব্যয় মেটাতে তখন হিমশিম খেতে হয় তাদের। সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ে পিছিয়ে পড়ে তারা।

জানতে চাইলে বিআইডিএস’র ফেলো ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে চালের প্রাপ্তিতে একটা ঘাটতি রয়েছে। এটা মোকাবিলায় সরকারকে কর্মসূচি নিতে হবে। সরকার চালও আমদানি করবে। তবে বাস্তবে তার সুফল পেতে কত সময় লাগবে সেটাই এখন প্রশ্ন।

তিনি বলেন, সরকারের সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে মোটা চালের দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু চিকন চালের দাম আমন মৌসুম ছাড়া তেমন কমে না। ফলে চিকন চালের দাম নিয়ে শঙ্কা সহসাই কাটছে না।