উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, ডলার সংকট, বিদ্যুৎ সংকট, গ্যাসের মজুত হ্রাস, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, তারল্য সংকট, ই-কমার্স খাতে অনিয়ম, নেতিবাচক রপ্তানি বাণিজ্য সবকিছু মিলিয়ে একটি সংকটের ভেতর দিয়ে কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। রয়েছে নানা অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও। তৈরি পোশাক শিল্প, মানবসম্পদ, রেমিট্যান্স, প্রাকৃতিক সম্পদ, মৎস্য সম্পদ, সামুদ্রিক সম্পদ, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন সম্ভাবনাময় সূচক আমাদের অর্থনীতি চাকা সচল করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জুলাই ২০২৩ হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯.৬৯ শতাংশ। যা স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি। প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিমের ডজন ১৫০-১৬০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, মরিচ, চিনি, মশলা, ব্রয়লারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের
ঊর্ধ্বগতি সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রায় বিরাট প্রভাব ফেলছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি প্রতিকূল প্রভাব বিস্তার করছে বিশেষ করে পরিবহন খাতে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে ডলার সংকট। যার কারণে টাকার অর্থমূল্য কমে যাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে, আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে চলমান ঘাটতি বিদ্যুৎ সংকটকে আরও ত্বরান্বিত করছে। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে সরকার নিয়মিত লোডশেডিং অব্যাহত রাখছে। ফলে সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ, জনজীবন বিপর্যস্ত এবং শিল্প কারখানাগুলোতে অসংগতি নিয়মিত। এদিকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েই যাচ্ছে। যার কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে, যা অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে বড় অন্তরায়। ই-কমার্স খাতে ঘটে যাচ্ছে একের পর এক অনিয়ম এবং দেওলিয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা। ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ সম্প্রতি গঞঋঊ-এর উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটা বড় আকারের মূলধন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ই-কমার্স খাতের অনিয়মের জন্য।
দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নি¤œমুখী। এসব সংকটের মূলে কতগুলো কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান অবকাঠামোগত দুর্বলতা অন্যতম। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দৃঢ় ভিতের অবকাঠামো প্রয়োজন। দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান অন্তরায়। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত দুর্নীতি নিরসনে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া। ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্য অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে অন্যতম ব্যাধি। ঋণখেলাপিদের অনুকূলে বারবার আইন সংশোধন এবং নীতি প্রণয়ন ব্যাংকিং খাতকে ঋণখেলাপিবান্ধব করেছে। খেলাপি ঋণকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে। সুতরাং প্রয়োজনে আইন আরও কঠোর করতে হবে, যেখানে ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বর্জন করার বিধান থাকবে। অন্যথায়, অর্থনীতির এ দুরবস্থা কাটানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাছাড়া দেশের বাজারে বিদেশি পণ্যের আধিপত্য দেশীয় পণ্যের বাজারকে নিরুৎসাহিত করছে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায়।
দেশের অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে কম সঞ্চয় একটি অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে মোট জাতীয় সঞ্চয় দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ; আগের অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয় কমেছে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। সঞ্চয়ের পরিমাণ কমে যাওয়া অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছে। অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায়। বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি করে। ফলে প্রতি বছর বাণিজ্য ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। সংকট ছাপিয়ে রয়েছে সম্ভাবনাও। দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের অবদান অনস্বীকার্য এবং উল্লেখযোগ্য। প্রস্তাবিত মেগা প্রজেক্টগুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে অপেক্ষমাণ। আমাদের রয়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে সামুদ্রিক এবং প্রাকৃতিক সম্পদ। উপযুক্ত উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা এসব সম্পদ কাজে লাগাতে পারি। রয়েছে বিপুল পরিমাণ মানব সম্পদ। সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ বিপুল পরিমাণ মানব সম্পদকে উৎপাদন, বণ্টন এবং দেশের বিভিন্ন খাতে কাজে লাগাতে হবে। তবেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হবে। আমাদের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা তৈরি পোশাক শিল্প। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান এ খাতের। সুতরাং আমাদের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে সম্ভাব্য সম্ভাবনাগুলোকে আমাদের কাজে লাগানোর সৎ পদক্ষেপ নিতে হবে।
আল আমিন
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়