বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: চাঁদপুরের প্রতিটি উপজেলায় ইটভাটাগুলোতে ব্যবহƒত হচ্ছে ফসলি জমির উর্বর মাটি। জমির এই মাটি ব্যবহার করে ইটভাটা মালিকরা তৈরি করছে ইট। ফসলি জমির উর্বর মাটি বা টপ সয়েল ইটভাটায় চলে যাওয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব ফসলি জমি। আর এতে কমছে ফসলি জমির পরিমাণ। দিন যতই যাচ্ছে ততই হ্রাস পাচ্ছে জেলার ফসল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার হার। ফসলি জমি রক্ষায় জেলা প্রশাসন জেলার হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, কচুয়া, মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ, ফরিদগঞ্জ, হাইমচর, চাঁদপুর সদর উপজেলায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার চাঁদপুর সদর উপজেলার ইব্রাহিমপুর ইউনিয়নের কৃষিজমি নষ্ট করে অবৈধভাবে মাটি কাটা ও বিক্রি করার অভিযোগে পুলিশের সহযোগিতায় চাঁদপুর সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ হেলাল চৌধুরী কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। এ সময় অবৈধভাবে মাটি কাটার দায়ে ঘটনাস্থল থেকে আটজনকে আটক করা হয়। অবৈধভাবে মাটি কাটার দায়ে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ মোতাবেক প্রত্যেককে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদ-ে দ-িত করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলায় ইটভাটা ব্যবসা পরিচালনা ও ফসলি জমির মাটি কেনাবেচার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের-দপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক নেতা, পরিবহন নেতা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। এ সিন্ডিকেটের মধ্যে শাহরাস্তির সিন্ডিকেট বেশ সক্রিয়। স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় কর্তাব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা, ক্ষমতা বলয়ে থাকা পোষ্যপুত্রদের ম্যানেজ করেই চলে শাহরাস্তিতে ফসলি জমির টপ সয়েল বিক্রির মহোৎসব। শাহরাস্তিতে অবৈধ ইটভাটাও রয়েছে অনেক। স্থানীয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় ইটভাটাগুলো চলমান রয়েছে। এই উপজেলায় মটি কিনতে আগে থেকেই ইটভাটা মালিকরা দাদন তুলে দিচ্ছেন সিন্ডিকেটের সদস্যদের হাতে। সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতরা আবার গ্রামে গ্রামে তাদের লোক পাঠাচ্ছেন জানার জন্য, কোন কোন কৃষক পরিবার অসুবিধায় আছেন। কৃষকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কৌশলে টাকা ধার দেওয়া হয় কৃষকদের। সিন্ডিকেটের লোকেরা কারসাজি করে কৃষকদের বিপদের সময় বর্ষা মৌসুম বা প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন দাদন দিয়ে ফাঁদে ফেলে কৃষকের জমির উর্বর মাটি কিনে নিচ্ছেন।
অপরদিকে বিভিন্ন উপজেলার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, বারবার বারণ করা সত্ত্বেও ইটভাটা মালিকরা উর্বর মাটির ব্যবহার করে ইট বানাচ্ছেন। এ নিয়ে সচেতন মহলের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। চাঁদপুরের আট উপজেলায় কর্মরত কৃষি কর্মকর্তারা উর্বর ভূমি কমে যাওয়ার বিষয়টি জানলেও নানান সীমাবদ্ধতার কারণে পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। ইট বানানোর জন্য ফসলি জমির এক ফুট পর্যন্ত মাটি কিনে নিচ্ছেন ইটভাটার মালিকরা। কোথাও আবার পুরো জমির মাটি কিনে নিচ্ছেন। এতে উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে ফসলি জমিগুলো। এ কারণে প্রতি বছরই কমছে ফসল উৎপাদন।
কচুয়া উপজেলার বিভিন্ন ঠিকাদার একই ইউনিয়নের পূর্ব কালচোঁ গ্রামে অবস্থিত মেসার্স এইচ বি ব্রিকস নামে একটি ইটভাটায় মাটি সরবরাহ করছেন। হাজীগঞ্জ উপজেলায় আবদুল খালেক নামে আরেক ঠিকাদার ১১নং পশ্চিম হাটিলা ইউনিয়নের নোয়াপাড়া মজুমদার বাড়িসংলগ্ন পূর্ব মাঠের ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে একই ইউনিয়নের কে এল বি ব্রিকসকে মাটি সরবরাহ করছেন। মাটি পরিবহনের ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাঁচা-পাকা বিভিন্ন সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লেই থেমে নেই সিন্ডিকেটের মাটি বাণিজ্যের মহোৎসব। হাজীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত মেসার্স রনি ব্রিকসের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, মূলত কৃষক যে জমিতে ফসল কম উৎপাদন করতে পারে সে জমিরই মাটি বিক্রি করে। আমরা কারও কাছ থেকে জোর করে মাটি কিনি না। তবে মাটি কেনার কাজ বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন টাইপের নেতারা।
চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জালাল উদ্দিন জানান, ফসলি জমির উর্বর মাটি ব্যবহার করলে স্বাভাবিকভাবেই সেই জমিতে ফসল উৎপাদন কম হয়। তাই ইটভাটায় ফসলি জমির উর্বর মাটি ব্যবহারে সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরা কৃষকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব ডিসির। আমরা চাইলেও আইনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না।
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশ বিপর্যয় হতে পারে এমন স্থানে আর কোনো নতুন ইটভাটার পরিবেশের ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে চাঁদপুরে মোট ১২৬টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৯০টি বৈধ এবং ৩৬টি অবৈধ হলেও হাইকোর্টে রিট করে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।