বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর : পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ভূমি একজনের নামে রেকর্ড থাকলেও খতিয়ান সৃজন হয়েছে আরেকজনের নামে। চাঁদপুরে আট উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভূমি অফিসে এসব ঘটনা এখন হরহামেশাই ঘটছে। অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া খতিয়ান সৃজন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন ভূমি-সংশ্লিষ্ট অসাধু কিছু কর্মকর্তা। ফলে জেলায় ভূমিসংক্রান্ত মিথ্যা মামলার সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এমন অভিযোগ হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তির উপজেলার অসংখ্য ভুক্তভোগী ভূমি সেবাগ্রহীতার। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভূমি সেবাগ্রহীতাদের পুঁজি করে বিভিন্ন ইউনিয়নের কতিপয় অসাধু ভূমি কর্মকর্তার জাল জালিয়াতি বাণিজ্যের চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহরাস্তি উপজেলার ২৩৪ নং রাঢ়া মৌজার সিএস এসএ ১৯ নম্বর বিএস ৩৮৫ নম্বর খতিয়ানভুক্ত ৭০৮ দাগে ১৬ আনা হিস্যায় প্রাপ্ত ১৮ শতাংশ ভূমির মধ্যে হাফিজ উদ্দিনের ছেলে শামছল হক শূন্য দশমিক ৬৬৭ হিস্যায় ১২ শতাংশ ও আনোয়ারা খাতুন শূন্য দশমিক ৩৩৩ হিস্যায় ৬ শতাংশ ভূমির মালিক ও দখলকার থাকেন। জীবদ্দশায় শামছল হক তার মালিকীয় ৯.২৪ শতাংশ ভূমি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করে নিঃশর্তবান হন। যার খতিয়ান নম্বর ৮৯৮ ও ৯০০। মৃত্যুর পর অবশিষ্ট ২.৭৬ শতাংশ ভূমিতে শামছল হকের উত্তরাধিকারী ওয়ারিশরা মালিক ও দখলকার থাকেন।
মূল ভূমির মালিক ও দখলকার শামছল হক মৃত্যুবরণ করায় তার ওয়ারিশ মো. আবদুল ছামাদ গং পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ২ শতাংশ ৭৬ পয়েন্ট ভূমি থেকে ১৯৮৯ সালের ২২ জুন ২৮২৩ নম্বর দলিলমূলে ১ শতাংশ ৫০ পয়েন্ট সম্পত্তি একই বাড়ির বাসিন্দা মো. আবদুছ ছাত্তারের কাছে বিক্রয় করেন। কিন্তু চতুর ছাত্তার দলিল করার সময় দলিলে ১০ শতাংশ ৫০ পয়েন্ট জায়গা লিখে নিয়ে দলিল সম্পাদন করেন। যে জায়গার প্রকৃত মালিক শামছল হকের বোনসহ অপরাপর ওয়ারিশরা। আবদুছ ছাত্তার চতুরতার আশ্রয় নিয়ে ভুয়া দলিল সৃজনের ফলে ভূমি অফিসের রেকর্ডে শামছল হকের ওয়ারিশ ছামাদ গংদের নামে ১০ শতাংশ ৫০ পয়েন্ট জায়গা না থাকায় দীর্ঘ ৩০ বছর পর্যন্ত আবদুছ ছাত্তারের সৃজীত দলিলমূলে ১০ শতাংশ ৫০ পয়েন্ট জায়গার খারিজ খতিয়ান সৃজন করা সম্ভব হয়নি।
এরই মধ্যে আবদুছ ছাত্তারের ওয়ারিশ ছেলে দেলোয়ার গং ৩০ বছর পর্যন্ত ১০ শতাংশ ৫০ পয়েন্ট জায়গা জোরপূর্বক দখল করে রেখে প্রতিপক্ষ শামছল হকের ওয়ারিশগণের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৪৫ ধারায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট চাঁদপুরের আদালতে মামলা করেন। যার নং ১৩৯৫/২০২২, স্মারক নং-৪১০৪। যার তদন্ত রিপোর্ট ইতোমধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে শাহরাস্তি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় থেকে। ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে আবদুছ ছাত্তারের ওয়ারিশ দেলোয়ার গং বর্তমানে সম্পত্তিতে দখলে আছে।
অপরদিকে শাহরাস্তির সংশ্লিষ্ট টামটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আবদুছ ছাত্তার ১৯৮৯ সালে যে ১০ শতাংশ ৫০ পয়েন্ট জায়গার দলিল সৃজন করেছেন সে দলিল অনুযায়ী রেকর্ডে জায়গা না থাকায় তার ওয়ারিশরা কোনো খারিজ খতিয়ান সৃজন করতে পারেননি ৩০ বছর পর্যন্ত। আবদুছ ছাত্তারের ওয়ারিশ দেলোয়ার গং ১৯৮৯ সালের দলিলমূলে কোনো খারিজ খতিয়ান সৃজন করতে না পেরে একই দলিল মূলে আরও একটি দলিল সৃজন করে নেন নিজ পরিবারের সবার নামে। সেই দলিল অনুযায়ী নামজারি মামলা নং ২০৭৬/২০২২-২০২৩, আবেদন নং ৪১৭১৫২২, তারিখ ০৩/১১/২০২২ মূলে জাল জালিয়াতি করে ৯৪৭ নম্বর একটি খতিয়ান সৃজন করেন অবৈধ উপায়ে। ভূমি অফিসের বিভিন্ন ডকুমেন্টস পর্যালোচনায় জাল জালিয়াতির বিষয়টি উঠে আসে। এ ঘটনায় প্রায় দেড় মাস আগে শাহরাস্তি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে ৯৪৭নং খতিয়ান বাতিলের আবেদন করেন ভুক্তভোগী শামছল হকের ছেলে আবদুল মুনাফ। যা চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে রেজিস্ট্রারভুক্ত হলেও বিভিন্ন অজুহাতে অদ্যাবধি মিসকেইসটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়নি। রেজিস্ট্রার ক্রমিক নং ১১৫০ তারিখ ৩ সেপ্টেম্বর। সদ্য বদলি হওয়া শাহিরাস্তি উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো কামাল হোসেনের অসদুপায় অবলম্বনের কারণে দীর্ঘ দুই মাস পরও মিসকেইসটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে শাহরাস্তির সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেজওয়ানা চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, খতিয়ান বাতিলের জন্য লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ভূমি সহকারী কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। মিসকেইস নথিভুক্ত করার পর শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হবে। কোনো অসংগতি থাকলে খতিয়ান বাতিল করে জায়গা মূল খতিয়ানে নেয়ার সুযোগ আছে।
অপরদিকে হাজীগঞ্জ উপজেলাতেও খতিয়ান জাল জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে অহরহ। উপজেলার ৮নং হাটিলা পূর্ব ইউনিয়নের হাটিলা মৌজার আবদুল হাকিম ব্যাপারির সম্পত্তি সংক্রান্ত জমাখারিজ মোকদ্দমা নং ৩৬৮৩/২০১৯-২০২০, পুনঃবিচার মোকদ্দমা নং-২৫/২০২০-২১, নামজারি মামলা নং-৩১৮৬কে পুঁজি করে হাজীগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসের নাজির ইব্রাহিম খলিল জাল জালিয়াতি করে ২৩৮৮নং খতিয়ান সৃজন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি ২৩৮৮ নম্বর খতিয়ান বাতিলের আবেদন জমা দেয়ার পর অফিস থেকে সেই ফাইল গায়েব করার অভিযোগও রয়েছে ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে। পরে আবার দুই মাস পর দ্বিতীয় বার খতিয়ান বাতিলের আবেদন করার পর নামজারি মোকদ্দমা ১১১ নথিভুক্ত হয়ে শুনানির দিন ধার্য করার কথা থাকলে ভূমি অফিসের ‘দিদিচক্র’র ঘুষ বাণিজ্যের কারণে নামজারি মোকদ্দমা ১১১ আর আলোর মুখ দেখেনি। এরই মধ্যে সম্পত্তিসংক্রান্ত বিরোধ নিষষ্পত্তি না হওয়ায় আদালতে পাঁচটি মামলা দায়ের করেছেন এক ভাই আরেক ভাইয়ের বিরুদ্ধে। এসব মিথ্যা মামলার নেপথ্যের কারিগর জাল-জালিয়াতি করে ভুয়া খতিয়ান সৃজনে সহায়তাকারী কতিপয় অসাধু ভূমিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।