Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 3:15 am

চাঁদপুরে ছয় খাল পুনঃখননে অনিয়মের অভিযোগ

বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: বন্যা, নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে আলোচিত ‘ডেল্টা প্ল্যান, ২১০০’ অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। এটি গৃহীত হওয়ার পর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ‘৬৪ জেলার অভ্যন্তরস্থ ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। ২০১৮ সালে প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদনের পর একযোগে সারাদেশে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ৪৪৮টি ছোট নদী ও খালের চার হাজার ৮৬ কিলোমিটার পুনঃখনন সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও চাঁদপুরের ছয়টি খাল পুনঃখনন কাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ফলে কাজের ক্ষেত্রে দ্বৈততা, বন্যা, কভিড, জনগণের বাধা ও ঠিকাদারদের গাফিলতির কারণে প্রকল্পের কাজে শতভাগ অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।

প্রকল্পে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লার (পূর্বাঞ্চল) তত্ত্বাবধানে চাঁদপুর পওর সার্কেলের আওতায় প্রতি উপজেলায় একটি করে মোট ছয়টি খাল পুনঃখননের কাজ শুরু হয়। খাল পুনঃখনন শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন খালের দুপাশে গাছপালা ও বিভিন্ন স্থাপনা থাকায় এবং ভূমি অধিগ্রহণ না থাকায় শতভাগ ডিজাইন ও স্পেসিফেকশন অনুযায়ী খাল পুনঃখননের কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদার। ফলে সরকারের শতকোটি টাকার প্রকল্পের সুফল ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন চাঁদপুরবাসী।

চাঁদপুর পওর সার্কেল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চাঁদপুরের সদর উপজেলায় সেচ প্রকল্পের আওতাভুক্ত রাজার খালে ছয় কিলোমিটার ১০০ মিটার খাল পুনঃখননের কাজ পায় ঢাকার নয়াপল্টনের সামস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষ দিন পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খাল পুনঃখননের অগ্রগতি ছিল মাত্র তিন শতাংশ। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জটিলতার কারণে রাজার খাল খনন কাজের বাস্তব অগ্রগতি আর আলোর মুখ দেখেনি।

একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের আওতাভুক্ত রুমুর খালে ৯ কিলোমিটার ৭১৫ মিটার খাল পুনঃখননের কথা থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষ দিন পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খাল খননের অগ্রগতি ছিল ৬৫ শতাংশ। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে কার্যাদেশ অনুযায়ী ৯ কিলোমিটার ৭১৫ মিটার খননকাজের ৮০ শতাংশ কাজ সমাপ্ত করে ৩৬ লাখ টাকা বিল উত্তোলন করেছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া সামস ইঞ্জিনিয়ারিং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হাইমচর উপজেলায় চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের আওতাভুক্ত ডি-২ সি খালের পাঁচ কিলোমিটার ১০০ মিটার কাজ করে। ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষ দিন পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খাল পুনঃখননের অগ্রগতি ছিল ৭০ শতাংশ। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বাপাউবো সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে প্রায় ২৫ লাখ টাকা বিল উত্তোলন করেছেন বলে জানা গেছে।

কচুয়া উপজেলায় প্রকল্পের আওতায় (প্রথম পর্যায়) ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চক্রাবেনচো চাংগিনি খালে ছয় কিলোমিটার ৮৫০ মিটার খাল পুনঃখননের কাজ শুরু করে কুমিল্লার ঝাউতলার সারা এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষদিন পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খাল পুনঃখননের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১৫ লাখ টাকা বিল উত্তোলন করেছে বলে জানা গেছে।

একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাজীগঞ্জ উপজেলায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সোনাপুর খালে পাঁচ কিলোমিটার পুনঃখননের কথা থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষদিন পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খাল খননের অগ্রগতি ছিল ৪৫ শতাংশ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে কার্যাদেশ অনুযায়ী পাঁচ কিলোমিটার খননকাজের বিল বাবদ প্রায় ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

শাহরাস্তি উপজেলায় প্রকল্পের আওতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নরিংপুর খালে আট কিলোমিটার ৬০০ মিটার খাল পুনঃখননের কাজ শুরু করে মশিয়র রহমান নামের কুমিল্লার ঝাউতলার একজন  ঠিকাদার। ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষদিন পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের খাল পুনঃখননের অগ্রগতি ছিল ৩৫ শতাংশ। এরই মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১৫ লাখ টাকা বিল উত্তোলন করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠানের কাজের বাস্তব অগ্রগতি ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ঠিকাদার এরই মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ টাকার বিল উত্তোলন করলেও খাল খনন কাজে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।

এই প্রকল্পের কার্যাদেশ অনুযায়ী চাঁদপুর জেলার ছয়টি উপজেলায় ছয়টি খাল খনন কাজের দৈর্ঘ্য ধরা হয় ৪১ কিলোমিটার ৩৬৫ মিটার। চুক্তিমূল্য ধরা হয় প্রায় চার কোটি টাকা। এরই মধ্যে কাজের হার অনুযায়ী ঠিকাদারদের প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ টাকা বিল দেয়া হয়েছে।

অপরদিকে একই প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়ে) আওতায় চাঁদপুর জেলার আট উপজেলার ৩৫টি নদী খাল খননের প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে বাপাউবো চাঁদপুর পওর সার্কেল সূত্রে জানা গেছে। তবে প্রকল্পে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ কবে নাগাদ শুরু হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো কিছুই জানেন না বাপাউবো চাঁদপুর পওর সার্কেলের সংশ্লিষ্টরা।

অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরিত প্রস্তাবনায় ২৫ নম্বর ক্রমিকে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে কুচির খাল খননের প্রস্তাব করা হয়েছে। কুচির খাল খননে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু চলমান একটি কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যেই কয়েক দফা প্রস্তাবিত কুচির খাল খনন কাজ হয়েছে বলে বিএডিসি (ক্ষুদ্রসেচ) উইং সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, প্রকল্পটির উদ্দেশ্যÑদেশের ৬৪ জেলার ছোট নদী, খাল ও জলাশয়গুলোর পানিধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বছরব্যাপী সেচ সুবিধা প্রদান। দেড় লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা। নদী, খাল ও জলাশয়গুলোর আনুমানিক ছয় লাখ হেক্টর এলাকায় পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতা বাড়ানো। পুনঃখননের মাধ্যমে ছোট নদী, খাল ও জলাশয়গুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা। এজন্য নাব্য বৃদ্ধির মাধ্যমে দুই হাজার কিলোমিটার নৌ-চলাচল সহজ করার জন্য সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে দুই হাজার ২৭৯ কোটি ৫৪ লাখ ৬১ হাজার টাকা ব্যয়ে এক বছর দুই মাস মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর ৬৪ জেলায় ছোট নদী-খাল পুনঃখনন প্রকল্পটিতে অনুমোদন দেয়া হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। পরে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। আর ব্যয় কমিয়ে দুই হাজার ২৭১ কোটি ১৩ লাখ ৬৭ হাজার টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি দেখানো হয় ৭২ শতাংশ।

সূত্রমতে, মূল প্রকল্পে পুনঃখননের কাজ ছিল ৪৪৮টির। এর মধ্যে ৮৮টি ছোট নদী, ৩৫২টি খাল ও আটটি জলাশয়। প্রথম সংশোধনীতে এ খননের কাজ বেড়ে দাঁড়ায় ৫১১টিতে। এখন সবমিলে ২২০টি বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬৬৮টি, যার মধ্যে ছোট নদী ১০৯টি, খাল ৫৩৩টি ও জলাশয় ১৫টি। এই পুনঃখনন কাজে খরচ ধরা হয়েছে দুই হাজার ২১৭ কোটি ৯৮ লাখ ৭১ হাজার টাকা। অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা উচ্ছেদ কাজে খরচ বাড়িয়ে ৪২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা থেকে দাঁড়ায় ৬৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুর পওর সার্কেলের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী নকিব আল হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, চাঁদপুরের ছয়টি খালে শতভাগ খাল পুনঃখনন কাজ সম্পন্ন হয়নি বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে। সারা বাংলাদেশের একই অবস্থা। আমরা প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।