বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) সরকারের অন্যতম বৃহৎ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি। এ কর্মসূচি কর্মক্ষম দুস্থ পরিবারগুলোর জন্য স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ গ্রামীণ অবকাঠোমো নির্মাণ, মেরামত, সংস্কারসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্ম সম্পাদনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন, যুগোপযোগী এবং অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে চাঁদপুরে কোনো নিয়মনীতি না মেনে দুই বছর ধরে প্রকল্পের সব তথ্য গোপন করে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, দুই বছর ধরে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসের সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকল্পের ইউনিয়নব্যাপী উপকারভোগী, প্রকল্পের তালিকা বরাদ্দকৃত অর্থ, নন-ওয়েজ কস্ট, ওয়েজ কস্ট, উপকারভোগীর সংখ্যাসহ সব তথ্য গোপন করে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে। অনুসন্ধানে বিগত দুই অর্থবছরে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অসংখ্য প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়।
সূত্রমতে, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতায় বছরের কর্মহীন মৌসুমে কর্মক্ষম বেকার শ্রমিকদের জন্য দুটি পর্বে ৮০ দিনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থানের মাধ্যমে কর্মক্ষম দুস্থ পরিবারগুলোর দারিদ্র্য নিরসনের মাধ্যমে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে সক্ষমতা বৃদ্ধিই এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য। কর্মসূচির প্রথম পর্বে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিন এবং দ্বিতীয় পর্বে মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪০ দিন কর্মসংস্থান করা হয়। তবে প্রয়োজনবোধে আঞ্চলিক ভিত্তিতে কাজের সময়কাল নির্ধারণ ক্যালেন্ডার ভিন্ন হয়। শ্রমিক মজুরির হার প্রচলিত বাজারদরের ওপর নির্ভর করে সময়ে সময়ে সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করা হয়। উপকারভোগীর সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে অধিকতর দারিদ্র্যপীড়িত উপজেলাগুলোয় অগ্রাধিকার দেয়া হলেও তথ্য গোপন করার কারণে চাঁদপুরে প্রকল্পের আওতাভুক্ত দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার মানুষের দারিদ্র্যের হার ও ক্যাটেগরিভিত্তিক প্রকল্প না নিয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের মর্জিমাফিক প্রকল্প দিয়ে নামমাত্র কাজ করেই প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের মচ্ছব চলেছে, যা অনুসন্ধানে উঠে আসে।
অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, চাঁদপুর জেলায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৯ ইউনিয়নের ১০ হাজার ৬০৫ উপকারভোগীর মধ্যে চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪ ইউনিয়নে ৯৩৬ জন, ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৫ ইউনিয়নে এক হাজার ৪৬০ জন, হাইমচর উপজেলার ছয় ইউনিয়নে ৭২১ জন, হাজীগঞ্জের ১২ ইউনিয়নে এক হাজার ৪৭২ জন, কচুয়া উপজেলার ১২ ইউনিয়নে দুই হাজার ৯২৮ জন, মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ছয় ইউনিয়নে ৬৩৩ জন, মতলব উত্তর উপজেলায় ১৪ ইউনিয়নে এক হাজার ৩৫৯ জন ও শাহরাস্তি উপজেলায় ১০ ইউনিয়নে এক হাজার ৯৬ জন উপকারকারভোগী প্রকল্পের আওতাভুক্ত। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলার আট উপজেলায় প্রকল্পের নন-ওয়েজ কস্ট খাতে ৭৭ লাখ ৮৪ হাজার ৫৫৭ টাকা সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুকূলে বরাদ্দ প্রদান করা হয়, যে তথ্য গোপন করার কারণে অধিকাংশ ইউপি চেয়ারম্যান, প্রকল্প কমিটির সভাপতি ইউপি সদস্য নন-ওয়েজ কস্ট সম্পর্কে কিছুই জানতেন না বলে অভিযোগ ওঠে। অপরদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম পর্যায়ে তথ্য গোপন করার কারণে ওয়েজ কস্ট (শ্রমিক মজুরী) নন-ওয়েজ, সরদার মজুরি, ডিজিটাল সার্ভিস চার্জসহ জিটুপি খাতে বরাদ্দ বিভাজন সম্পর্কে ইউনিয়নের প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা কিছুই জানতেন না বলে অভিযোগ ওঠে। যদিও প্রকল্পের সব তথ্য জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নভিত্তিক উপকারভোগীসহ সাধারণ মানুষকে জানাতে প্রকাশের নির্দেশনা রয়েছে। প্রকল্পের তথ্য প্রদানেও অপারগতা প্রকাশের অভিযোগ ওঠে অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা পিআইও’র বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য সরবরাহ না করেই প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের মচ্ছবে মেতে ওঠেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা, এমন অসংখ্য অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে উঠে আসে অতিদরিদ্রদের জন্য আত্মকর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) প্রকল্পে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম পর্যায়ের বাজেট বরাদ্দে জেলার কচুয়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের দুই হাজার ৯২৮ উপকারভোগী অনুযায়ী নন-ওয়েজ কস্ট খাতে বরাদ্দ ছিল ২১ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮৫ টাকা। ওয়েজ কস্ট খাতে বরাদ্দ ছিল চার কোটি ৬৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৯নং কড়ইয়া ইউনিয়নে ৩৪৮ জবকার্ডধারী উপকারভোগীর বিপরীতে এই ইউনিয়নে প্রকল্প ছিল ৯টি। প্রকল্পের বাজেট বরাদ্দ বিশ্লেষণে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে প্রকল্পের নন-ওয়েজ কস্ট খাতের টাকা কোথায় কীভাবে ব্যবহত হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, কড়ইয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের আকানিয়া উত্তর পাড়া জসিমের বাড়ি থেকে তালুকদার বাড়ি হয়ে হাশেম মাস্টারের বাড়ির পশ্চিম পাশের রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় ১০০ মিটার পর্যন্ত মাটির কাজ করা হয়েছে। এ প্রকল্পে ৪৬ জবকার্ডধারী উপকারভোগী ছিল। ইজিপিপি নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ শেষ না করেই উপজেলার প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে ইউপি সদস্য মো. কামরুজ্জামান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে।
ইউপি সদস্য কাঞ্চন মিথ্যা তথ্য দিয়েই প্রকল্পের ৪৬ উপকারভোগী জবকার্ডধারীর প্রায় সাত লাখ ১৬ হাজার টাকা আত্মসাৎ করছেন, এমন অভিযোগ ছিল প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত স্থানীয় বাসিন্দাদের।
অপরদিকে একই ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডে চাঁদপুর বারেক মাস্টারের বাড়ির ব্রিজ থেকে চাঁদপুর বড় বাড়ির মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় ১০০ মিটার মাটির কাজ করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আবুল হাশেম। এই প্রকল্পে উপকারভোগী রয়েছেন ৩৯ জন। ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দের প্রকল্পে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ১০০ মিটার মাটির কাজ করে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করছেন আবুল হাশেম মেম্বার, এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের ইজিপিপি প্রকল্পের প্রভার্টি ইনডেক্স অনুযায়ী, এ ক্যাটেগরিতে থাকা কচুয়ার ৯নং কড়ইয়া ইউনিয়নে দারিদ্র্যের হার ৪০ দশমিক ২০ ভাগ উল্লেখ থাকলেও রহস্যজনক কারণে তালিকা থেকে বাদ পড়েছে অধিকাংশ দরিদ্র মানুষ। এতে নামমাত্র কাগজে-কলমে উপকারভোগী থাকলেও প্রকৃত অসহায় দিনমজুর মানুষজন প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
অপরদিকে ২০২৩-২০৪ অর্থবছরে হাজীগঞ্জ উপজেলার ৯নং গন্ধর্ব্যপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদপুর রাজ্জাকের বাড়ি থেকে কামালের দোকান পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে ৪৪ শ্রমিকের পরিবর্তে প্রকল্পের নির্দেশনা অমান্য করে এক্সাভেটর দিয়ে মাটি কেটে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা, সরেজমিনে যার সত্যতা পাওয়া যায়।
এছাড়া শাহরাস্তি উপজেলার টামটা দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জহিরুল আলম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে রাজাপুরা ইয়াকুবের বাড়ি থেকে আলীপুর তালুকদার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে এক্সাভেটর দিয়ে কাজ করিয়ে প্রকল্পের ৩৯ শ্রমিকের মজুরি বরাদ্দ পাঁচ লাখ ১৪ হাজার ৮০০ টাকা, একই ইউনিয়নের ধোপল্যা নোয়াবাড়ীর এমরানের ভদ্রা থেকে তালুকদার বাড়ী ও পাটওয়ারী বাড়ী থেকে মধ্যমাঠ পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের নামে নামমাত্র কাজ করে ৩১ শ্রমিকের মজুরি বরাদ্দ চার লাখ ৯ হাজার ২০০ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ ওঠে। যদিও চেয়ারম্যান প্রকল্পের অর্থ লোপাটের কথা অস্বীকার করে বলেন, প্রকল্পে ইউপি সদস্যরা সভাপতি। আমার অর্থ লোপাট করার সুযোগ নেই। এ প্রতিনিধিকে কোনো তথ্য দিতে পারবেন না বলে অসহযোগিতা করেন এ জনপ্রতিনিধি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি জবাবদিহি করবেন বলে জানান। তবে সরেজমিনে দেখা যায়, শ্রমিকের পরিবর্তে এক্সাভেটর দিয়ে রাস্তার কাজ করা হয়েছে।
প্রকল্পে বরাদ্দকৃত টাকা পরিশোধে সংশ্লিষ্ট উপজেলা ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে দাখিলকৃত উপকারভোগীদের মোবাইল নম্বর-সংবলিত তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের নিয়ম থাকলেও স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম আর তথ্য গোপনের কারণে কেউই তালিকা যাচাই-বাছাই করতে পারেননি। বিগত সময়ে সিমকার্ডধারী উপকারভোগীদের মোবাইলে টাকা আসার পর সেই টাকা কৌশলে উত্তোলন করে সামান্য কিছু টাকা তাদের দিয়ে প্রকল্পের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নেই উপকারভোগীর সিম কার্ড চেয়ারম্যান মেম্বারদের কাছে থাকায় উপকারভোগীরা তাদের ন্যায্য কাজের মজুরি না পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। অনুসন্ধানের এর সত্যতা পাওয়া যায়। উপকারভোগীর এসব সিমে মজুরি আসার পর সেই সিম ভাগ করে নিতেন এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার, পিআইও, ট্যাগ অফিসার, ইউপি সচিবসহ স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ রয়েছে ফরিদগঞ্জের ‘কোটিপতি পিআইও’ মিল্টন দস্তিদারের বিরুদ্ধে। প্রকল্পের কাজ না করেই বিগত দুই বছরে অসংখ্য প্রকল্পের অর্থ লোপাট করেছেন তিনি। শেয়ার বিজের পরিচয় পেয়ে সবসময় তিনি মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও তার বিরুদ্ধে রয়েছে ইজিপিপি প্রকল্পের অর্থ অত্মসাতের পাহাড়সম অভিযোগ।
এভাবেই প্রায় প্রতিটি উপজেলায় প্রতিটি ইউনিয়নে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের মচ্ছব চললেও রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি প্রকল্পে অনিয়মকারী কারও বিরুদ্ধে। এতে প্রকল্পের নামে শুধু অর্থ আত্মসাতের মহোৎসব চললেও ভেস্তে গেছে প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এরই ধারাবাহিকতায় একই প্রক্রিয়ায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্পের তথ্য গোপনের মাধ্যমে প্রকৃত উপকারভোগীর সিম নম্বর পরিবর্তন করে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের ‘গোপন পরিকল্পনা’ করেই ইজিপিপি প্রথম পর্যায়ের প্রকল্প জমা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্ষমতার দোহাই দেয়া ৮৯ ইউনিয়নের সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতাসহ প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।