Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 7:35 pm

চাঁদপুরে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ আহরণ

বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: জাতীয় সম্পদ ইলিশের উৎপাদন ও প্রাপ্যতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমিষের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি ইলিশ ধরা নিষিদ্ধকালে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হয় ‘ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’। সারাদেশে ২৯ জেলার ১৩৪ উপজেলায় প্রকল্পটির কাজ চলমান। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে মৎস্য সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়ন ও অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো।

এরই ধারাবাহিকতায় প্রকল্পের আওতায় মা ইলিশ রক্ষায় চাঁদপুরের জেলা ট্রাস্কফোর্স কমিটি ও সংশ্লিষ্টরা নানা বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। তবু চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনায় সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কিছু অসাধু জেলে মা ইলিশ নিধন করছে।

প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল ও হাইমচরের চরভৈরবী পর্যন্ত নদীতে কিছু এলাকায় গোপনে মা ইলিশ নিধন করছে অসাধু জেলেরা। নৌকায়ই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে মা ইলিশ। চাঁদপুর থেকে নৌপথে ঢাকা বা বরিশাল যাওয়ার পথে মা ইলিশ নিধনের এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণে প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ অ্যাক্ট, ১৯৫০-এর অধীন প্রণীত প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ রুলস, ১৯৮৫ অনুযায়ী মোট ২২ দিন (৪ থেকে ২৫ অক্টোবর) সারা দেশে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে  ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুত ও বিপণন নিষিদ্ধ।

সরকারের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা হলে কমপক্ষে এক থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলেও প্রাণনাশের ভয়ে অসহায় জেলেরা জাল নিয়ে নদীতে নামতে বাধ্য হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা দাদন দিয়ে রাখা জেলেদের ইলিশ মাছ ধরতে বাধ্য করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলেরা জানিয়েছেন, আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগেপরে মোট ১৫ থকে ১৭ দিন ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম। এ সময় সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসে নদীতে। মা ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র সুরক্ষিত রাখতে বছরে তিন সপ্তাহ ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে সন্ধ্যা, রাত ও ভোর হলেই জমে উঠে অবৈধ ইলিশের হাট। প্রতি বছরের মতো এবারও স্থানীয় প্রশাসন মা ইলিশ শিকারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে কিন্তু কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না শিকারীদের অসাধু জেলেদের।

মাছ ব্যবসায়ীরাই জেলেদের জাল ফেলতে বাধ্য করে। দাম বেশি ও দাদন দেয়ার লোভ দেখায় কেউ কেউ। জেলেদের যারা অগ্রিম টাকা নেন, তারা বাধ্য হন মাছ ধরতে। প্রশাসনের কতিপয় অনৈতিক সুবিধাভোগী সুবিধা নিয়ে এ কাজ করছে।

অভিযান পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু ব্যক্তি অভিযানের নামে প্রতি বছর বাণিজ্য করে থাকে এই সময়। অসাধু ব্যক্তিরা প্রতি বছর তাদের বাণিজ্যে সফল করতে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। কোনো বছর বিকাশের মাধ্যমে লেনদেন করে, আবার কোনো বছর দালালদের মাধ্যমে লেনদেন করে। চলতি বছর মাছ ধরা জেলেপল্লিগুলোয় লোকের মাধ্যমে অভিযানের খবরা-খবর জানাতে নৌকা প্রতি চুক্তি করছে। তাদের বাণিজ্য সফল করতে এবছর চুক্তির মাধ্যম হিসেবে কতিপয় জেলে নেতা ও গণমাধ্যম কর্মীদের ব্যবহার করছে। রাতে অবৈধভাবে মাছ পরিবহন করতেও কয়েক জন সুবিধাভোগী গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যবহার করা হয়েছে।

মধ্যস্থকারীদের কাজ হলো অভিযান কখন পরিচালনা হবে সেই খবর জানানো। এতে নৌকা প্রতি প্রতিদিন হাজার টাকা পর্যন্ত চুক্তি করেছে বলে জানা যায়। চুক্তির মধ্যে রয়েছেÑরওনাগোয়াল, পুরান ফায়ার সার্ভিস, আনন্দ বাজার, বিষ্ণপুর ইউনিয়নের লালপুর গ্রাম, বাবুর্চিঘাট, দোকানঘর, লক্ষ্মীপুর, হরিণা ঘাটের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে, আখনের হাটসহ আরও বেশ কয়েকটি স্থান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন লঞ্চচালক বলেন, ‘সরকার এই সময় মা ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে জাল ফেলা নিষিদ্ধ করেছে। এ সময় আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যে নৌযান চালানোর কথা। কিন্তু সেটার জো নেই। রাতভর জেলেদের টর্চের আলো এসে পড়ছে আমাদের চোখে। স্বাভাবিক সময়েও জেলেদের নির্দেশনায় আমাদের লঞ্চ চালাতে হয়। এখন তো নদীতে ইলিশ ধরা বন্ধ। তারপরও তাদের মাছ ধরতে দেখি।’

আরেক লঞ্চ চালক বলেন, ঢাকা সদরঘাট থেকে দক্ষিণাঞ্চলে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলো মুন্সীগঞ্জের পর থেকে নদীতে স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারে না। রাতে জাল ফেলে জেলেরা নৌকায় বসে থাকে। বড় নৌযান আসতে দেখলে তারা আলো জ্বালিয়ে নৌযানগুলোকে দিক বদলানোর নির্দেশ দেয়।

এ বিষয়ে চাঁদপুরের ডিসি অঞ্জনা খান মজলিশ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিচ্ছি। কেউ যদি রাতে জাল ফেলে, অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া মা ইলিশ রক্ষায় এবার আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। অভয়াশ্রম চলাকালে জেলা ট্রাস্কফোর্সের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। অভয়াশ্রমের ২২ দিন আমরা ড্রেজার বন্ধ রেখেছি। নদীতে ব্যক্তিমালিকানাধীন সব স্পিডবোট বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করেছি। জেলেপল্লিসহ অন্যান্য জায়গায় এ-সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে মাইকিং এবং প্রচার প্রচারণারও করা হয়েছে। নিষিদ্ধ ২২ দিন মৎস্য আহরণে বিরত থাকা প্রতিটি জেলে পরিবারকে ২০ কেজি হারে চাল দেয়া হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সচেতন জনসাধারণের সম্মিলিত প্রয়াসে রাতের বেলায় চুরি করে যারা মাছ ধরা চেষ্টা করছে তাদের প্রতিহত করা সম্ভব। মা ইলিশ রক্ষা করতে আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।’