Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 5:47 pm

চাঁদপুরে ১৯০ কোটি টাকার নদীতীর সংরক্ষণ প্রকল্পে অনিয়ম

[মেঘনার ভাঙন থেকে চাঁদপুরের হরিণা ফেরিঘাট এবং চরভৈরবি এলাকার কাটাখাল বাজার রক্ষা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ দিকে। প্রকল্পের কাজে অনিয়ম আর গোঁজামিলের অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে এ সংক্রান্ত নানা তথ্য উঠে এসেছে। এ নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ প্রকাশ হচ্ছে প্রথম পর্ব]

মনির উদ্দিন ও বেলায়েত সুমন: পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত ‘মেঘনা নদীর ভাঙন হতে চাঁদপুর জেলার হরিণা ফেরিঘাট এবং চরভৈরবি এলাকার কাটাখাল বাজার রক্ষা প্রকল্প’ ২০১৭ সালে অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। শুরু থেকেই প্রকল্পটিতে মেঘনার তীর সংরক্ষণে অনিয়ম আর গোঁজামিলে কাজের অভিযোগ উঠে ঠিকাদারসহ প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আর কিছুদিন বাকি থাকলেও শেষ হয়নি প্রকল্পের আওতাভুক্ত তীর সংরক্ষণ কাজ। নামমাত্র তীর সংরক্ষণ করেই কোটি কোটি টাকা লোপাটের পাঁয়তারা করছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। ফলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ও প্রকল্প এলাকার জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন কাগজে কলমে শতভাগ দেখা গেলেও ভবিষ্যতে প্রকল্পের সুফল পাবেন না নদী-তীরবর্তী এলাকার মানুষ।

জানা গেছে, মেঘনার ভাঙন থেকে চাঁদপুরের হরিণা ফেরিঘাট এবং চরভৈরবি এলাকার কাটাখাল বাজার রক্ষা প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১৯০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ই-জিপি টেন্ডার অনুযায়ী, চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলায় ১০টি প্যাকেজের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন এলাকা নির্ধারণ করে কাজ বণ্টন করা হয় ঠিকাদারদের। এতে ঠিকাদারের পক্ষে প্রকল্প এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা কৌশলে প্রকল্পের প্যাকেজের কোটি কোটি টাকার কাজ পরিচালনা করে। কৌশলে কাজ হাতিয়ে নেয়ার পর প্রকল্পের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালীরা তাদের মর্জিমাফিক কাজ করতে থাকে। ফলে নদী তীর সংরক্ষণ কাজে ডাম্পিং প্লেসিং ম্যাটেরিয়াল (সিসি ব্লক, হার্ড রক, জিওব্যাগ, বোল্ডার, জিও টিউব) প্রস্তুতকরণ ও প্রতিস্থাপন কাজে দায়সারা গোঁজামিল দিয়ে কাজ চলমান রাখায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না আশঙ্কা স্থানীয়দের। যদিও প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেউ কেউ এসব অনিয়মের কথা অস্বীকার করে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

প্রকল্প এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে নদীতীরে সিসি ব্লক, জিওব্যাগ দিয়ে ঠেসে দেয়া হয়েছে। পরিকল্পিত তীর সংরক্ষণ না করে যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা হচ্ছে সিসি ব্লক ও জিও ব্যাগ।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পে তিনটি প্যাকেজের মধ্যে ৯৩০ মিটার কাজের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে শতভাগ। প্রথম প্যাকেজে হরিণা ফেরিঘাটের উত্তরে ৩১৫ মিটার তীর সংরক্ষণ কাজ করে ঢাকার মানিকনগরের ‘এমএস তাজুল ইসলাম’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি ১২ কোটি ৭২ লাখ টাকার কাজ করে। প্যাকেজের শর্তানুযায়ী, প্রকল্প এলাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ৩৪ হাজার ১১৬টি ভিন্ন ভিন্ন সাইজের সিসি ব্লক ও ২৫০ কেজির এক লাখ ৫৯ হাজার ১৪টি জিওব্যাগ প্রতিস্থাপন করে কাজ শেষ করেছে।

দ্বিতীয় প্যাকেজে হরিণা ফেরিঘাট এলাকায় ৩০০ মিটার তীর সংরক্ষণকাজ করে ঢাকার মতিঝিলের ‘এমএস হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ১২ কোটি ৮৯ লাখ টাকার কাজ করে এ প্রতিষ্ঠানটি। শর্তানুযায়ী, প্রকল্প এলাকায় ২৫০ কেজির ১ লাখ ৫১ হাজার ৪৪২টি জিওব্যাগ ও ৩৬ হাজার ৮৪১টি ভিন্ন ভিন্ন সাইজের সিসি ব্লক প্রতিস্থাপন করে কাজ শেষ করেছে।

তৃতীয় প্যাকেজে হরিণা ফেরিঘাটের দক্ষিণে ১৩ কোটি ১০ লাখ টাকায় ৩১৫ মিটার কাজ করে ঢাকার এসএসইসিএল-কে এসএ ওয়েল জেবি নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্প এলাকায় ২৫০ কেজির ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৪টি জিওব্যাগ ও ৩৫ হাজার ৬৪২টি ভিন্ন ভিন্ন সাইজের সিসি ব্লক প্রতিস্থাপন করে।

তিনটি প্যাকেজে ঠিকাদাররা নদীতীর সংরক্ষণে কোটি কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন করলেও কোথাও টেকসই কাজ হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

১৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা চুক্তিমূল্যের চতুর্থ প্যাকেজে ৪৩০ মিটার কাজ, ১৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা চুক্তিমূল্যের পঞ্চম প্যাকেজের কাজও সম্পন্ন করে এসএসইসিএল-কে এসএ ওয়েল জেবি নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। প্যাকেজে হাইমচরের চরভৈরবি এলাকার কাটাখাল জালিয়াচরের উত্তর অংশে নদীতীর থেকে ৫০ মিটার নদীর ভেতরের অংশেও ব্লক প্রতিস্থাপন করে কাজ শেষ করে এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এমন অভিযোগ স্থানীদের। নদীতীরে এমন গোঁজামিলের কাজ করায় কাটাখাল এলাকার বাসিন্দারা রয়েছেন নদীতে ঘরবাড়িবিলীন হওয়ার আতঙ্কে।

অপরদিকে ষষ্ঠ প্যাকেজে ১২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা চুক্তিমূল্যে চরভৈরবি এলাকার কাটাখাল জালিয়াচর গ্রামের পার্শ্ববর্তী স্থানে ১৬৫ মিটার ও ১৩নং হানারচর ইউনিয়নের হরিণা ফেরিঘাটসংলগ্ন নন্দীঘাট এলাকায় ৭৮ দশমিক ৫০ মিটারের দুইটি অ্যান্ড টার্মিনেশন নির্মাণের কথা থাকলেও এখনও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। যদিও সংশ্লিষ্টরা কাগজে কলমে ১৩২ দশমিক ৫৮ মিটারের দুইটি অ্যান্ড টার্মিনেশন নির্মাণকাজের সার্বিক অগ্রগতি দেখিয়েছে ৭১ ভাগ।

এছাড়া ৯, ১০ ও ১১নং প্যাকেজে ১২০০ মিটার কাজের মধ্যে ৯নং প্যাকেজে ১৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকার ৩০০ মিটার কাজের অগ্রগতি ৬২ ভাগ। ১০নং প্যাকেজে ২৬ কোটি ২২ লাখ টাকার ৪৫০ মিটার কাজের অগ্রগতি ৬৪ ভাগ।

১১নং প্যাকেজে ২৬ কোটি ৩১ লাখ টাকার ৪৫০ মিটার কাজের অগ্রগতি ৮৪ ভাগ কাগজে কলমে দেখানো হলেও ঠিকাদারের পক্ষে ৯ ও ১১নং প্যাকেজের কাজ নিজের মর্জিমাফিক করছেন হাইমচরের স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা। যিনি বিগত এক যুগে নদীতীর সংরক্ষণের কাজ করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন। এমনকি কাজ শেষ না করেই বিগত সময়ে এ প্রভাবশালী নেতা প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে বিল উত্তোলন করে আÍসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধানকালে চরভৈরবি এলাকার দক্ষিণ বগুলা এলাকায় এমন সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে পাউবো চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী রেফাত জামিল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকল্পে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। মার্চের শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের ৮৪ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। অসমাপ্ত কাজ চলতি বছর শেষ হবে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য। এছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্টদের অবহিত করেছি।