চাঁদ দেখা: যন্ত্র নয় বরং ঠিক করুন তন্ত্রমন্ত্র

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরের আগে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এরপরে ধর্ম মন্ত্রণালয়; তাদের হাতে টেলিস্কোপ থাকা সত্তে¡ও সেগুলো পুরানো বলে নতুন করে থিওডোলাইট জাতীয় টেলিস্কোপ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যার প্রতিটির দাম পড়বে নূন্যতম ৫০ লাখ টাকার মতো। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রীর এমন সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক মনে হলেও কারিগরি দিকে থেকে এমন সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য। এমনটা রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের নতুন আরেকটা খাতই শুধু তৈরি করবে।

চাঁদ দেখা বিষয়ক আলোচনার শুরুতেই যে বিষয়াটা পরিষ্কার করা দরকার তা হচ্ছে, খালি চোখে চাঁদ দেখা (হিলাল) আর আরবি চন্দ্রমাস শুরু হওয়ার মাঝে কিছুটা পার্থক্য আছে। বর্তমানে সৌদিআরব সরকার, তুরস্ক, ইউরোপীয় ফতোয়া কাউন্সিল এবং নর্থ আমেরিকা ফিকহ কাউন্সিল চন্দ্রমাসের হিসাব নির্ণয়ে কিছু ফর্মুলা ব্যবহার করে হিজরি চন্দ্রবর্ষপঞ্জী তৈরি করে সেই মতে রোজা ও ঈদের দিনক্ষণ অনুসরণ করেন। এখানে হিলাল বা খালি চোখে চাঁদ দেখা যাওয়ার সম্ভাবনাকে আমলে নেওয়া হয় না। আর খালি চোখে চাঁদ দেখা বা হিলালের ক্ষেত্রে এ ফর্মুলাগুলোর সঠিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ।

সৌদি হিসাব পদ্ধতির ভিত্তিতে বলা হয় যদি মুন কনজাংকশন (পৃথিবী সূর্য ও চন্দ্র একই সরল রৈখিক অবস্থানে) সূর্যাস্তের আগে হয় এবং চন্দ্রাস্ত সূর্যাস্তের পরে হয়, তাহলে নতুন চাঁদের মাস শুরু হবে। তবে এ পদ্ধতিতে ঠিক ওইদিন চাঁদ দৃশ্যমান হতেও পারে আবার খোদ সৌদিআরবেই নাও হতে পারে। ফলে মাঝে মাঝে দেখা দেয় বিতর্ক। আর বিশ্বব্যাপী একইদিনে খালি চোখে চাঁদ দেখা যায় না বলে একইদিনে ঈদ উদযাপন করা হবে কি হবে না; এ নিয়ে রয়েছে বহু পুরানো বিতর্ক। এ বিতর্কের ভিতরে না ঢুকেই আমরা বাংলাদেশের চাঁদ দেখা কমিটির জন্য স্থানীয় সমাধান দিতে চাই।

আন্তঃধর্মীয় বিদ্যালয় ও বিভিন্ন দেশের মুসলমান সমাজগুলো একইদিনে ঈদ উদযাপন না করলে পশ্চিমের দেশে বসবাসরত মুসলমানদের ব্যবসা অফিস ও স্কুলের ছুটিতে নানাবিধ ব্যবস্থাপনা সমস্যা তৈরি হয়। ঈদ ও অন্যান্য বড় ধর্মীয় দিবসে সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সাধারণ ছুটি থাকে বিধায় বাংলাদেশে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রোজা, ঈদ ও অন্যান্য ধর্মীয় দিবস পালন ব্যবস্থাপনা দিকে থেকে ঝামেলাহীন বলা চলে। আবার বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম সমাজও খালি চোখে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রোজার শুরু, শেষ এবং ঈদ উদযাপনের পক্ষপাতী। এমতাবস্থায় দরকার শুধু তিনটি বিশেষ বিষয়ে মনোনিবেশ করা-

প্রথমত; আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে নির্মিত চন্দ্রের অবস্থানকারী সফটওয়্যারগুলোর মাধ্যমে অতি সহজে যে কোন দিন ক্ষণে চন্দ্রের অবস্থান নির্ণয়ের জ্ঞান রাখা। দ্বিতীয়ত; ভুল দিনে চাঁদ দেখার চেষ্টা না করা, কিংবা ভুল দিনে চাঁদ উঠার তথ্য সংগ্রহ শুরু না করা। এতে করে কিছু দায়িত্বহীন উৎস ভুল তথ্য দিয়ে বা শোনা কথায় চাঁদ দেখা কমিটিকে বিতর্কিত করে। তৃতীয়ত; খালি চোখে চাঁদ দেখা (হিলাল) আর আরবি চন্দ্রমাস শুরু হওয়ার মাঝে কিছুটা পার্থক্যকে কারিগরি দিক থেকে সঠিকভাবে বোঝার চেষ্টা। পাশাপাশি লুনার কনজাংকশনের ধারণা রাখা এবং লুনার কনজাংকশনের সঙ্গে খালি চোখে চাঁদ দেখার পদ্ধতিগত সম্পর্ক তৈরি করা।

আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে লুনার কনজাংকশন এবং চন্দ্রের অবস্থান নির্ণয় করা যায়। তথাপি খালি চোখে ঠিক প্রথম কোন দিন চাঁদ দেখা যাবে, তা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ থাকে। আবার আকাশ কতটা মেঘমুক্ত, কুয়াশা ও ধোঁয়াহীন পরিষ্কার; তার ওপরও চাঁদ দেখা (হিলাল) নির্ভর করে। তবে এটা নিয়েও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের নির্দেশনা আছে। খালি চোখে চাঁদ দেখতে হলে চন্দ্র আর সূর্যের মাঝে অন্তত সাড়ে ১০ ডিগ্রি কেšণিক অবস্থা থাকতে হবে।

একই সরল রেখায় পৃথিবী সূর্য ও চাঁদ আসার পর (মুন কনজাংকশন) এ কোন তৈরি করতে অন্তত ১৫ থেকে ২৩ ঘন্টা সময় লাগে। জোতির্বিদ্যার তথ্য অনুযায়ী মুন কনজাংকশন পরবর্তী ১৫-২৩ ঘন্টার মধ্যে নতুন চাঁদের ক্রিসেন্ট বা হিলাল দেখা যাবে খালি চোখে। মুন কনজাংকশন কখন হবে তা বিজ্ঞান শতভাগ নির্ভুলভাবে হিসাব করতে পারে।

যে সব অঞ্চলে মুন কনজাংকশন পরবর্তী ১৫-২৩ ঘন্টার মধ্যে সূর্যাস্ত হবে সেসব অঞ্চলে খালি চোখে চাঁদ দেখা যাবে। মুন কনজাংকশনের পর ১৫ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার আগে আে কেউ খালি চোখে চাঁদ দেখার দাবি করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
অর্থাৎ, বাংলাদেশ বা ঢাকার চাঁদ দেখা কমিটি দেশের একাধিক (যেমন দক্ষিণ উত্তরের কোনাকুনি টেকনাফ-তেতুলিয়া কিংবা পশ্চিম পূর্বের কোনাকুনি সাতক্ষীরা-সিলেট) স্থানে মুন কনজাংকশনের হিসেব করবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে।

এর জন্য www.timeanddate.com/astronomy/moonকিংবা www.mooncalc.org, theskylive.com অন্য যে কোন নির্ভরযোগ্য অনলাইন ফ্রি সফটওয়্যার টুল ব্যবহার করা যেতে পারে। তারপর নিচের তিনটি পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। যথা: এক. এ স্থানগুলোর বা দেশের অন্য কোথাও মুন কনজাংকশনের পরবীর্ততে সূর্যাস্তের আগে সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে অন্তত সাড়ে দশ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থান তৈরি হতে পারে কি-না? এ হিসেব কঠিন মনে হলে পরবর্তি ধাপে যেতে হবে।

দুই. মুন কনজাংকশনের পরবর্তিতে অন্তত ১৫ ঘন্টার পরে কোথাও সূর্যাস্ত হবে কি-না?
তিন. এক ও দুই নম্বর পদ্ধতির উভয়টিতেই একেবারে সঠিকভাবে জানা যাবে কোন বিশেষ দিনে বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখা যাবে কি যাবে না। কঠিন মনে হলে আরেকটি সহজ পদ্ধতি আছে। সেটি হচ্ছে www.mooncalc.org বা এরকম সফটওয়ার সাইটে গিয়ে দেশের একাধিক স্থানের অবস্থানে দেখাতে হবে নতুন চাঁদ ওঠার সম্ভাবনা কতো শতাংশ।

যদি নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার সম্ভাবনা এক শতাংশের নিচে থাকে, তাহলেও এটা নিশ্চিত যে খালি চোখে দেশের কোথাও চাঁদ দেখা যাবে না। অর্থাৎ, সূর্যাস্তের আগে সূর্য ও চন্দ্রের কৌণিক অবস্থান সাড়ে দশ ডিগ্রির কম হলে মুন কনজাংকশনের ১৫ ঘন্টার আগেই সূর্যাস্ত হয়ে গেলে কিংবা নতুন চাঁদের এক শতাংশের কম দেখা গেলে বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখার কোন সম্ভাবনা থাকবে না।

জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি ওইদিনে তার আঞ্চলিক উৎস থেকে চাঁদ ওঠার তথ্য সংগ্রহ করবে না। কেউ দাবি করলে বৈজ্ঞানিকভাবে তা অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে এবং সেভাবে বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্তসহ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি তৈরি করতে হবে।

অন্যদিকে, সূর্যাস্তের আগে সূর্য ও চন্দ্রের কৌণিক অবস্থান সাড়ে দশ ডিগ্রি বা বেশি হলে, মুন কনজাংকশনের ১৫ ঘন্টার পরে দেশের আকাশে সূর্যাস্ত হলে কিংবা নতুন চাঁদের ১ শতাংশের বেশি বা দেড় শতাংশের কাছাকাছি দেখা গেলে বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখা যাবে অবশ্যই। তখন কেবল উৎস থেকে নিশ্চিত হওয়ার আনুষ্ঠানিকতা বাকি থাকবে। মেঘলা কিংবা ধোঁয়াশা-কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ থাকলে আল হাদিসে বর্ণিত ধর্মীয় নিয়মের উপমহাদেশীয় পদ্ধতি মেনে কিংবা ৩০ দিন পূর্ণ হওয়া সাপেক্ষেও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

উপরিউক্ত কারিগরি পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এতোটাই এগিয়েছে যে চাঁদ দেখার জন্য আলাদাভাবে থিওডোলাইট টেলিস্কোপ বা অন্য কোন টেলিস্কোপ ব্যবহারের কিংবা কেনার প্রয়োজন একেবারেই নেই। আবার যে চাঁদ খালি চোখে দেখা যাবে না তা অতি উন্নত টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে সুন্নত নিয়মের হিলালও পালন হবে না। ফলে অপ্রয়োজনীয় খরচে না যেতে আমরা চাঁদ দেখা কমিটিকে পরামর্শ দেই।

বিপরীতে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের কারগরি তথ্য বিশ্লেষণভিত্তিক চাঁদ দেখা ব্যবস্থাপনা সাজাতে পরামর্শ দেই। নবীজি (সা.) অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে অক্ষায়িত করেছেন। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, টেলিস্কোপসহ বর্তমানের চাঁদ দেখা যন্ত্রপাতিগুলো অব্যবহৃত না রেখে সেগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করাই অধিক যুক্তিযুক্ত। প্রয়োজনে চাঁদ দেখা কমিটি সময়ে সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কারগরি সহায়তায় নিতে পারে। উন্নত যন্ত্রপাতি অলস ফেলে না রেখে শিক্ষায় ব্যবহারকেই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করি। চাঁদ দেখা নিয়ে ফি বছর চলে আসা বিতর্কের অবসান হোক; এই কামুনা করি।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থের রচিয়তা
প্রকৌশলী, ইইই, বুয়েট
ইমেইল: faiz.taiyeb@gmail.com

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০