স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী বেশ কিছু সময় দেশে যে পাটের স্বর্ণযুগ চলছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে যুগের শিক্ষার্থীদের শৈশবে মুখস্থ করা ‘সোনালি আঁশ’ নামের রচনা থেকেই তা অনুধাবনযোগ্য। পরবর্তীকালে ক্রমে সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পণ্যটির কদর কমতে থাকে প্রধানত আন্তর্জাতিক বাজারে এর গুরুত্ব কমে আসায়। তখন থেকেই স্থানীয় চাষি পাট উৎপাদন থেকে সরে এসে ক্রমে অন্য পণ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন। তবে বর্তমান সরকারের আমলে, বিশেষত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী কর্তৃক পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের পর থেকে পাট ও পাটজাতপণ্য আবারও জনমনে আশা জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মেয়াদে কাঁচা পাট ও পাটপণ্য রফতানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় হয়েছে আনুমানিক চার হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। এদিকে গত পাঁচ বছরে বহুমুখী পাটপণ্যের রফতানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে ৩৭০ কোটি টাকার পাটপণ্য রফতানি হয়; ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০০ কোটি টাকায় এবং চলতি বছর সেটি ৮০০ কোটি টাকার মাইলফলক ছুঁতে পারবে বলে খাতসংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা। এটা নিছক আশাবাদ নয়; বরং জোরালো যুক্তি। বিশ্ববাজারে পাট ও পাটপণ্য উৎপাদন এবং রফতানিতে বাংলাদেশের শীর্ষ আসন ছিল এক সময়; যা এখন হƒত। ফলে ওই অবস্থানে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে জোর প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার। কাজটি সহজ হবে না নিঃসন্দেহে।
গতকালের শেয়ার বিজে ‘উৎপাদন স্থবিরতাই এখনও পাট খাতের বাধা’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি অনেক পাঠকের দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকবে। সেখানে আমাদের প্রতিনিধি কৌতূহলোদ্দীপক যে তথ্য জানিয়েছেন, তা হলো পাট উৎপাদনে স্থবিরতা সত্ত্বেও বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে দ্রুত। অন্য দিক থেকে দেখলে অধিক মুনাফার জন্য হলেও আমাদের পাট উৎপাদন বাড়ানো দরকার। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে পাট ও পাটপণ্যের মতো পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা বেড়েছে অনেক। সমস্যা হলো, প্রধানত জনসাধারণের ক্ষুধা মেটাতে আমাদের কৃষিজ উৎপাদন খাদ্যশস্যের ওপরই কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে অনেকটা; খাদ্যচাহিদা পূরণের তাগিদ বেশি থাকায় শস্য বৈচিত্র্যায়নের ওপর নজর দেওয়া যায়নি সেভাবে। ওই প্রেক্ষাপট বর্তমানে আমূল পরিবর্তিত, সেটিও বলা যায় না। ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সতর্কতার সঙ্গে জোরালো নীতি প্রণোদনা বাছাই করা প্রয়োজন। আরেকটি বিষয়, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যকে ‘প্রমোট’ করা। সেক্ষেত্রে বড় বাধা, এরই মধ্যে বৈশ্বিক বাজারে ভারতীয় পাটপণ্যের দাপট প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। রাতারাতি সে বাজারে নিজের পণ্য সম্প্রসারণ করা কঠিন। এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে মুখোমুখি প্রতিযোগিতাও আমাদের জন্য ক্ষতিকারক প্রমাণ হতে পারে। অগ্রাহ্য করা যাবে না, পাট ও পাটপণ্য রফতানিতে আমাদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে তারা। সুতরাং দেখা উচিত, এ বিষয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশটির সহায়তা মেলে কি না। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক যেসব সুবিধা ছিল, তা এখনও আছে; সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খাদ্যশস্য উৎপাদনের বাড়তি চাপ। অবশ্য পাটপণ্য বিপণনে বার বারই পিছিয়ে আমরা। আর এক্ষেত্রে ভারতীয় উদ্যোক্তাদের অগ্রসরমানতা লক্ষণীয়। ফলে সরকারিভাবে হোক বা বেসরকারি খাতের নেতৃত্বে, ভারতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে স্থানীয় পাটপণ্যের উপযুক্ত বিপণন কৌশল নির্ধারণে সংশ্লিষ্টরা আরও সক্রিয় হবেন এটাই কাম্য।
Add Comment