সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের প্রতি পাঁচ বছর পর ডিসেম্বরে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। ওই বিধিমালা অনুযায়ী, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রদর্শিত সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব বিবরণী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাখিল করবেন। প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে তার অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বা দখলে থাকা শেয়ার, সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বিমা পলিসি এবং ৫০ হাজার টাকা বা ততোধিক মূল্যের অলঙ্কারাদিসহ স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দেবেন। কিন্তু কখনোই এ বিধানকে আমলে নেননি সরকারি চাকুরেরা। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন ও দিয়েছেন। এরপর বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করে সরকারি চাকুরেদের সম্পদের হিসাব দিতে সব মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এতেও সাড়া মেলেনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
বিভিন্ন সময় পদস্থ সরাকারি চাকুরেদের জ্ঞাত আয়ের চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ খুঁজে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এমনকি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদেরও অঢেল সম্পত্তি দেখে বিস্ময়ে কাপালে ভাঁজ পড়েছে অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের। ১৯৭৯ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের প্রতি পাঁচ বছর পর ডিসেম্বরে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেয়ার বিধান প্রতিপালিত না হলেও এত দিন অন্তত প্রজাতন্ত্রের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার একটা আইনি ভিত্তি ছিল।
সরকার সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর সংশোধন করে সম্পদের বিবরণী জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়ার প্রেক্ষাপটে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, সম্পদ বিবরণীর বাধ্যবাধকতা না থাকলে দুর্নীতি উৎসাহিত হবে। সংস্থাটি বলেছে, এ উদ্যোগের ফলে দেশের প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারী আরও বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে।
টিআইবির বক্তব্যে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে বলেই ধারণা। যেখানে ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাগে আনা যাচ্ছে না প্রজাতন্ত্রের অসাধু কর্মচারীদের, সেখানে সরকারি চাকুরেদের সম্পদবিবরণীর বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহারে তারা আরও বেপরোয়া সাহসী হয়ে উঠবে। সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার মতো কোনো বিধান না থাকলে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নির্ভয়ে দুর্নীতি, এর মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা বাড়বে। একই সঙ্গে সেবা পেতে সরকারি অফিসে সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তি বাড়বে, অবৈধ অর্থ লেনদেন বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। বলা হয়ে থাকে, দুর্নীতি থামানো গেলে পদ্মা সেতুর মতো কয়েকটি সেতু আগেই নির্মাণ করা যেত। এখন আমরা কি না, দুর্নীতি সংঘটনের পথ খুলে দিচ্ছি। টিআইবি বলছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেয়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে নেয়ার যুক্তি বাস্তবে অর্থহীন। কারণ, আয়কর আইন, ২০২৩ অনুযায়ী তা সম্ভব নয়। কেননা দুদক দুর্নীতি বা বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ আহরণের অভিযোগে কোনো ব্যক্তির আয়কর বিবরণী আদালতের নির্দেশ ছাড়া দেখতে পারবে না। ফলে জবাবদিহির মুখোমুখি হওয়ার বদলে এই সংশোধনীর মাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীরা নতুন সুরক্ষা পাবেন। সত্যই এমন হলে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ আহরণের দায়ে সরকারি চাকুরেদের বিরুদ্ধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সরকার যাচাই-বাছাই করে আইন সংশোধন করবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।