নজরুল ইসলাম: চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পেতে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের (এমআর) জন্য সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার এ দুদিন নির্ধারণ করে দেয়া হলেও তা মানছেন না তারা। প্রতিদিনই তারা ভিড় করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। রোগীদের ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলতে প্রেসক্রিপশন নিয়ে করছেন টানাটানি। এ নির্ধারিত দিনের বাইরে অন্য দিনগুলোয় হাসপাতালে প্রবেশের ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের গুনতে হয় টাকা। টাকা দেয়া না হলে হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের হাতে হেনস্তার শিকার হতে হয় তাদের। আর চাকরি বাঁচানোর তাগিদে আনসার সদস্যদের শত হয়রানি উপেক্ষা করে প্রতিদিনই হাসপাতালে আসতে বাধ্য হন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা।
ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আনসার সদস্যদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে তারা প্রতিদিন হাসপাতালে প্রবেশ করেন। টাকা না দিলে প্রবেশ করা যায় না। প্রবেশ ফটকের গ্লাস বক্সে টাকার লেনদেন হয়। যে কোম্পানির প্রতিনিধি টাকা দেন না, তাকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না।
বিএসএমএমইউ থেকে নির্ধারিত সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার ছাড়াও কেন হাসপাতালে ডাক্তার ভিজিটে আসেনÑএকথা জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওষুধ কোম্পানির এক প্রতিনিধি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানি থেকে বাধ্য করা হয়, তাই আসি। কোম্পানি প্রত্যেক ডাক্তারের পেছনে টাকা ব্যয় করে থাকে। সেই ডাক্তাররা কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখছেন কি না, সেটি দেখার জন্য আমাদের দিনে কমপক্ষে ৫০টি প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে পাঠাতে বলা হয়। সেজন্য রোগীর প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলি। রোগীরা বিরক্ত হন, সেটা আমরাও বুঝি। কিন্তু চাকরি বাঁচাতে এসব করতে হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুদিন প্রবেশের অনুমতি দিলেও কোম্পানি প্রতিদিন আসতে বাধ্য করে।’
হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা কখনও কখনও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন বলে অভিযোগ তুলে আরেকজন প্রতিনিধি জানান, ‘টাকা দিয়ে আনসার সদস্যদের ম্যানেজ করে হাসপাতালে প্রবেশ করতে হয়। এরপর প্রতি ফ্লোরেই টাকা দিতে হয়। গেটে গ্লাস বক্সে টাকা দিতে হয়। মোবাইল ফোন নেয়ার পর সেটিও টাকা দিয়ে ছাড়াতে হয়। অথবা বলা হয়, ‘আপনার ম্যানেজারকে ডাকেন। আপনারা তো খোঁজখবর রাখেন না।’
ওষুধ কোম্পানির এক প্রতিনিধি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা অনার্স পাস করে চাকরিতে এসেছি। অনেকেই মাস্টার্স সম্পন্ন করা। শুধু চাকরির জন্য আমাদের আনসার সদস্যদের হেনস্তার শিকার হতে হয়। ওষুধ কোম্পানি আমাদের দিয়ে এসব কাজ না করালেও পারে। তাদের তো সার্ভে টিম রয়েছে। আমাদের শুধু শনিবার ও মঙ্গলবার বেলা ১টার পর ডাক্তার ভিজিট করলেই হয়। কিন্তু ওষুধ কোম্পানি থেকে আমাদের বাধ্য করা হয় প্রতিদিন হাসপাতালে আসতে। তাই বাধ্য হয়ে আসি।’
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার বিএসএমএমইউতে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগ-২-এর গেটের ভেতরে ফার্মাএশিয়ার এক প্রতিনিধির সঙ্গে আনসার সদস্য মামুন ও শহীদুল তরফদার বাকবিতণ্ডা করছেন। এরই মধ্যে ফার্মাএশিয়ার আরও তিন প্রতিনিধি সেখানে এলেন। তারা উত্তেজিত আনসার সদস্য মামুনকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। মামুন ওই প্রতিনিধির দিকে তেড়ে যাচ্ছেন। পরে মামুন শান্ত হলেন।
জানতে চাইলে ফার্মাএশিয়ার প্রতিনিধিরা বলেন, যে যেভাবে পারছে ম্যানেজ করছে। আমরা নতুন তো সেজন্য ঝামেলা করছে। আনসার সদস্য মামুন ওকে চিনতে পারেনি।
ঘটনাটি উল্লেখ করে বিএসএমএমইউর আনসার ক্যাম্প ইনচার্জ মনির হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি শেযার বিজকে বলেন, ‘অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’
ওষুধ কোম্পানি তো অভিযোগ দেয় না, তারা তো আনসার সদস্যদের ম্যানেজ করে; সেক্ষেত্রে আপনারা কী করে থাকেনÑজানতে চাইলে মনির হোসেন বলেন, ‘আমাদের গায়ে নির্দিষ্ট পোশাক থাকে তো। সেজন্য সহজেই চিহ্নিত করতে পারে। আমরা স্বল্প বেতনে চাকরি করি। কেউ যদি আমাদের কোনো সদস্যকে বকশিশ দিয়ে থাকে, সেটা সবার চোখে পড়ে। অথচ আরও কতজনই তো ম্যানেজ হচ্ছেন। সেগুলো কারও চোখে পড়ে না। তারপরও আমাদের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে আমরা তাকে সরিয়ে দিই। অন্যত্র পাঠিয়ে দিই। বিএসএমএমইউতে রাখি না।’
বিএসএমএমইউর সেকশন অফিসার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই তদারকি করি। তারপরও তারা ফাঁকফোকর খুঁজে প্রবেশ করে থাকে। আজ (বৃহস্পতিবার) গিয়ে একজনকে বকা দিয়েছি। ওষুধ কোম্পানির লোকজনসহ বসে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার বেলা ১টার পর তারা ডাক্তার ভিজিট করবেন, কিন্তু তারা তা মানছেন না। তারা বিভিন্নভাবে হাসপাতালে প্রবেশ করছেন।
এদিকে বিএসএমএমইউর সহকারী পরিচালক পবিত্র দেবনাথের বিরুদ্ধে ওষুধ কোম্পানি থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সুবিধা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পবিত্র দেবনাথ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সুযোগই নেই। আমাদের সবকিছু কঠোরভাবেই দমন করতে হয়। সেজন্য হয়তো এসব কথা বলা হচ্ছে।’