ইসমাইল আলী: এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রতি বছর বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম মূল্যে বিক্রি করায় এ লোকসান দিতে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটিকে। এ ঘাটতি পূরণে প্রথমে পিডিবিকে ঋণ দেয়া শুরু করে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে বিদ্যুৎ খাতে সরাসরি ভর্তুকি দেয়া শুরু হয়। এর চার বছরের মাথায় চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বেড়ে তিনগুণ দাঁড়াচ্ছে।
তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান ছিল রেকর্ড ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। আর সে বছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল তিন হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম হ্রাস ও কয়েকটি ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরে যায়। এতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর লোকসান কমে দাঁড়ায় আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আর ওই অর্থবছর সংস্থাটিকে ভর্তুকি দেয়া হয় সাত হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা।
লোকসানের বোঝা কমাতে গত মার্চে বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এর প্রভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান কমে দাঁড়ায় সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। আর গত অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়া হয় সাত হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছর শেষ না হওয়ায় এখনও লোকসানের হিসাব প্রণয়ন করেনি পিডিবি। যদিও তা ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
লোকসান বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তারা বলছেন, চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত এপ্রিলে রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আবার নতুন কয়েকটি কেন্দ্র উৎপাদন শুরু করায় ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে এলএনজি আমদানি হ্রাস পেয়েছে। এতে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় গ্যাস সরবরাহ কমেছে। ফলে বাধ্য হয়ে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়েছে। এসব কারণে চলতি অর্থবছর লোকসান বেড়ে যাবে।
এদিকে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে জানুয়ারি পর্যন্ত ছাড় করা হয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। আর ফেব্রুয়ারি ও মার্চের ভর্তুকি বাবদ আরও সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এতে ভর্তুকির পরিমাণ সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যদিও ভর্তুকির পুরোটা চলতি অর্থবছর ছাড় নাও হতে পারে বলে পিডিবিকে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আর ভর্তুকি কম পেলে লোকসান বাড়বে সংস্থাটির।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. বেলায়েত হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, বিদ্যুৎ কেনা ও বিক্রির মূল্যের পার্থক্যের ভিত্তিকে ঘাটতি হিসাব করা হয়। তার ভিত্তিতে ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছর পিডিবির জন্য ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। তবে প্রকৃতপক্ষে ঘাটতি আরও বেশি হতে পারে এ বছর। যদিও অর্থবছর শেষ হওয়ার আগে লোকসান বা ভর্তুকির সঠিক পরিমাণ বলা যাচ্ছে না।
এদিকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের জন্য সাড়ে ৯ হাজার ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগামী অর্থবছর ঘাটতি আরও বেশি হবে। এজন্য ভর্তুকি আরও বেশি লাগতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে কম মূল্যে বিক্রি করায় ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় ৬৩ হাজার ৬৩৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে পিডিবি। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান ছিল চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গুণে ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
এদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আগ পর্যন্ত লোকসানের ঘাটতি পূরণে পিডিবিকে ৫০ হাজার ৭৪০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে এ ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য না থাকায় ঋণকে ইক্যুইটিতে রূপান্তরের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে পিডিবি। যদিও বিষয়টি এখনও সুরাহা হয়নি।