Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 10:07 pm

চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পাস  

 

সংসদ প্রতিবেদক: আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে যে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা অপরিবর্তিত রেখেই অনুমোদিত হয়েছে বাজেট। জাতীয় সংসদে গতকাল বৃহস্পতিবার সর্বসম্মতিক্রমে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়। এটি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যয়ের বাজেট। যদিও বাজেটে অর্থায়নের জন্য নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করার প্রস্তাব করা হয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। ফলে বাজেটের অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

মঞ্জুরিকৃত দাবিগুলো নিষ্পত্তি শেষে গতকাল বেলা ১টা ৪৮ মিনিটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নির্দিষ্টকরণ বিল-২০১৭ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। অর্থমন্ত্রী গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন।

গতকাল ২০১৮ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারকে পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ২১৪ কোটি ১৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা খরচের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটি সরকারের গ্রস বাজেট। তবে সংসদে পাসকৃত এ বাজেটের পুরো অর্থ কখনও ব্যয় হয় না। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ দিতে হয়। এ অতিরিক্ত বরাদ্দ আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে বাজেটের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। তবে নিট বাজেট চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। যা আগামী অর্থবছরে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যয় করা হবে।

ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারকে পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ২১৪ কোটি ১৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা বরাদ্দের জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পক্ষ থেকে মোট ৫৯টি মঞ্জুরি দাবি সংসদে উত্থাপন করা হয়। এসব মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সাত সংসদ সদস্য মোট ৩৫২টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনেন। স্পিকারের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে এসব মঞ্জুরি দাবির মধ্যে তারা সাতটি দাবির ওপর আলোচনায় অংশ নেন। তবে সবগুলো ছাঁটাই প্রস্তাবই কণ্ঠভোটে নাকচ হয়। পরে ৫৯টি মঞ্জুরি দাবি সরকার ও বিরোধী দলের কণ্ঠভোটে সংসদে গৃহীত হয়।

অধিবেশনের শুরুতে প্রশ্নোত্তরপর্ব টেবিলে উত্থাপনের পর বাজেট পাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। স্পিকার সরাসরি মঞ্জুরি দাবিগুলো নিয়ে ভোটে চলে যান। এ সময় অর্থ বিভাগ খাত, স্থানীয় সরকার বিভাগ খাত, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ খাত, বিদ্যুৎ বিভাগ খাত, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ খাতের ওপর ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। এসব খাতের ওপর সাতজন সংসদ সদস্য তিন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব দেন।

এগুলো হচ্ছেÑনীতি অননুমোদন ছাঁটাই, প্রতীক ছাঁটাই ও মিতব্যয় ছাঁটাই। এসবের ওপর বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম, নুরুল ইসলাম ওমর, সেলিম উদ্দিন, নুরুল ইসলাম মিলন, কাজী ফিরোজ রশীদ এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজী ও বেগম রওশন আরা মান্নান। মঞ্জুরিকৃত দাবিগুলো নিষ্পত্তি শেষে দুপুর ১টা ৪৮ মিনিটে অর্থমন্ত্রী নির্দিষ্টকরণ বিল-২০১৭ সংসদে উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়।

অর্থ বিভাগ খাতে ৫৩ হাজার ৮৩৩ কোটি ৮০ লাখ ৭১ হাজার টাকার দাবি উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর বিপরীতে সাত সংসদ সদস্য ছাঁটাই প্রস্তাব করেন। অর্থই অনর্থের মূল, নানাভাবে টাকা বিদেশে পাচার, বেসরকারি ব্যাংক শেষ হয়ে যাচ্ছে, ব্যাংক খাতে লুটপাটের রাজস্ব কায়েম হয়েছে, অর্থমন্ত্রী খামোখা ব্যাংকিং খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে ইত্যাদি অভিযোগ উত্থাপন করে ছাঁটাই প্রস্তাব চান সদস্যরা। এসব কারণে ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি জানানো হয় সংসদে।

স্বাস্থ্য বিভাগ খাতে ১৬ হাজার ২০৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দাবি করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তবে বাজেট বরাদ্দের বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সেবার মান নি¤œমানের। হাসপাতালগুলোর গুণগত মান নেই। এত অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন হাসপাতাল, রোগীদের প্রতি চিকিৎসকদের অবহেলা বেড়েই চলেছে। তাই সেবার মান অবশ্যই বাড়াতে হবে। অনেক হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই।

স্থানীয় সরকার খাতে মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২৪ হাজার ৬৭৪ কোটি ১১ লাখ টাকা মঞ্জুর করার দাবি জানান। এর বিরোধিতা করে ছয় সংসদ সদস্য ছাঁটাই প্রস্তাব করেন। এ সময় তারা বলেন, এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। দেশের রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। অনেক জায়গায় রাস্তাঘাটের নির্মাণ ও সংস্কার কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। এসব তদারকি করা দরকার। সারা বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে অথচ ইউনিয়ন পরিষদগুলো এনালগ রয়ে গেছে। মন্ত্রী বরাদ্দ দেন; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রকৌশলীরা ঠিকমতো কাজ করেন না।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য ১৪ হাজার ৪০০ কোটি ৯ লাখ ৮১ হাজার টাকা মঞ্জুরি দাবি করা হয়। এর বিপরীতে সাতজন ছাঁটাই প্রস্তাব করেন। এ সময় তারা বলেন, বিগত তিন বছর ধরে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছি। হঠাৎ কী করে খাদ্য সংকট হলো। কেন এ অবস্থা। মনিটরিংয়ের সুব্যবস্থা নেই কেন? তারা বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে, তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দেশে লাগামহীনভাবে চালের দাম বেড়েছে। কেন এমন হলো, তা খতিয়ে দেখা দরকার। যে টাকা দাবি করা হয়েছে, তা যদি সঠিকভাবে ব্যয় করা হয়, তাহলে খাদ্য সংকট অনেকটা কমে যাবে।

জবাবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘চালের দাম বাড়ার কারণেই আমার বিরুদ্ধে এই বিষোদ্গার বলে বুঝতে পারছি। হাওর অঞ্চলের ফসল সব সময় আগে ওঠে। এবার হাওরে অকাল বন্যার কারণে ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। কমপক্ষে ছয় লাখ টন ফসল নষ্ট হয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলেও কিছু ফসল নষ্ট হয়েছে। এর সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চালের দাম বাড়িয়েছেন।’

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৯ হাজার ৬৯৭ কোটি ২১ লাখ টাকা মঞ্জুরি দাবি করেন। এর বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাব করেন পাঁচজন। তারা বলেন, নিরাপদ সড়কের জন্য অব্যবস্থাপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। পত্রিকা খুললেই দেখা যায় সড়কে প্রাণহানি ঘটছে। রাস্তাঘাট নির্মাণ করলেই হবে না, তা নিরাপদও করতে হবে। তারা বলেন, সড়ক নির্মাণের পর তা তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। এটা মন্ত্রীকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে সড়কের মান যেন ভালো হয়, তা দেখতে হবে। এমপিরা বলেন, মন্ত্রীর ওপর আমরা সবাই খুশি। কারণ তাকে সব সময় মাঠে দেখা যায়। তবে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় যখন আট হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা হয়, তখন একটু ভয় হয়।

বিদ্যুৎ খাতের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ১৮ হাজার ৮৯৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা মঞ্জুরি দাবি করেন। এর বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাব করেন ছয়জন। তারা বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। অথচ অনেক এলাকায় এখনও তা হয়নি। লোকসান আর ভর্তুকির কথা বলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যাবে না। গ্রামে দেখা যায় বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকে না। আবার অনেক জায়গায় গ্যাস থাকে না। এ মন্ত্রণালয়ে যেসব ত্রুটি আছে, তা ঠিক করা হচ্ছে না বলে ছাঁটাই প্রস্তাব দিয়েছি। তারা বলেন, সরকার বিদ্যুৎ খাতে অনেক এগিয়ে গেছে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ খাতে এখনও লুটপাট-দুর্নীতি রয়েছে। এসব দূর করা দরকার।

এমন বক্তব্যের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘অসম্ভব বলে কিছু নেই। আমরা কাজ করে যাচ্ছি, ইনশাল্লাহ সফল হবো। ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা হবে। বার বার বলছি, বিদ্যুতায়ন করা কিন্তু সহজ বিষয় নয়। বিদ্যুৎ নিয়ে এখন আমরা ভালোর দিকে যাচ্ছি।’

কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা মঞ্জুরি দাবি করেন। এর বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাব করেন ছয়জন। তারা বলেন, পিএসসি ও জেএসসি বাতিল করে এসএসসির ওপর জোর দেওয়া দরকার। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে এটা করা প্রয়োজন। তারা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওর দাবি করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু তা হচ্ছে না। সামনে নির্বাচন। আমরা এ অবস্থায় কীভাবে নির্বাচনী এলাকার মানুষের কাছে যাবো। উন্নয়নের অনেক বাধা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ঠিকাদাররা। সংসদ সদস্যরা বলেন, শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের মান বাড়ানো প্রয়োজন। এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও করার দাবি জানানো হচ্ছে। কিন্তু বার বার বলা হচ্ছে টাকা কম।

জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘অনেকে বলছেন আমাদের শিক্ষার মান কমেছে। এসব বললে শিক্ষার্থীদের মন খারাপ হয়। আসলে শিক্ষার মান কমেনি। আমাদের প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক। সেটা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

এসব আলোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী নির্দিষ্টকরণ বিল উত্থাপন করেন। পরে তা সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। এর আগে বুধবার সংসদে পাস হয় অর্থবিল-২০১৭। এতে ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে আবগারি শুল্ক কমানো হয়। একই সঙ্গে নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট/মূসক) আইন কার্যকর আগামী দুবছরের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধের পর অর্থমন্ত্রী ওইদিন তার সমাপনী বাজেট আলোচনায় এ ঘোষণা দেন। পরে অর্থবিল-২০১৭ পাসের মধ্য দিয়ে এসব ঘোষণা আইনি ভিত্তি পায়।