নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়েছে। গতকাল জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বাজেট পাস হয়, যা আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। তেমন পরিবর্তন ছাড়াই এ বাজেট পাস হয়েছে। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বাজেট এটি। আর অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিতের টানা দশম বাজেট।
সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ এ বাজেটে স্বাভাবিকভাবেই জনতুষ্টির উদ্যোগ বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে। ৭ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে এ বাজেট উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ বাজেটের ওপর ২২৩ জন সংসদ সদস্য মোট ৫৫ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট আলোচনা করেন।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী গত বৃহস্পতিবার অধিবেশনের শুরুতেই মঞ্জুরি দাবিতে আলোচনা করার কথা জানান। বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা এসব দাবিতে আলোচনা করেন। চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার এ বাজেটের মধ্যে অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এরমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা আদায় করতে হবে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে এনবিআর থেকে প্রাপ্তি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আয়কর ও অন্যান্য খাত থেকে প্রত্যক্ষ কর বাবদ এক লাখ দুই হাজার ২০১ কোটি এবং আমদানি ও রফতানি শুল্ক বাবদ ৩২ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। ভ্যাট খাতে এক লাখ ১০ হাজার ৫৪৩ কোটি ও সম্পূরক শুল্ক খাতে ৪৮ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা আয় হবে। আবগারি শুল্ক বাবদ দুই হাজার ৯১ কোটি ও টার্নওভার ট্যাক্স খাতে ১১ কোটি টাকা আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। এনবিআরবহির্ভূত কর খাতের আয় ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত রাজস্ব আয় ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। আর পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।
এ বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি দেখানো হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। ঘাটতির এ পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) চার দশমিক ৯ শতাংশ। এ ঘাটতির মধ্যে চার হাজার ৫১ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদান থেকে মেটানোর আশার কথা বলেছেন মুহিত। ওই অনুদান পাওয়া গেলে ঘাটতি থাকবে এক লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা, যা জিডিপির চার দশমিক সাত শতাংশ। গত অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের চেয়ে ১৬ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরের ব্যয়ের ফর্দ তৈরি করেছেন মুহিত, যা বিদায়ী বছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি।
রাজস্ব বাজেটে পরিবর্তন
মূসক ও আমদানি-রফতানি পর্যায়ে শুল্কের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন ছাড়া আয়করে কোনো পরিবর্তন ছাড়াই পাস হয়েছে। ইন্টারনেট সেবার ওপর বিদ্যমান ১৫ শতাংশ ভ্যাট পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। ব্যবসায়ী পর্যায়ে কম্পিউটার ও এর যন্ত্রাংশের ওপর আগের ধারাবাহিকতায় ভ্যাট অব্যাহতি রাখা হয়েছে। ভ্যাট অব্যাহতির সুযোগ দেওয়া হয়েছে স্থানীয়ভাবে মোবাইল উৎপাদনের পাশাপাশি সংযোজনেও। সোশ্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল বিজনেসের আলাদা সংজ্ঞা দিয়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে অনলাইন কেনাকাটার ওপর।
এদিকে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে পেট্রোলিয়াম জেলি ও ফিলামেন্ট বাল্বের ওপর। ভ্যাট ১৫ থেকে কমিয়ে সাত শতাংশ করা হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে মোটরসাইকেল সংযোজন, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির কমিশনের ওপর। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনের ক্ষেত্রে এয়ারলাইনসগুলোর বন্দরসেবার ওপর প্রযোজ্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট পুনর্বহাল করা হয়েছে। সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে নিম্ন সø্যাবের সিগারেটের ওপর। প্রতি ১০ শলাকার নিম্ন সø্যাবের মূল্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৩২ টাকা করা হলেও তা বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করা হয়েছে।
আমদানি-রফতানি পর্যায়ে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া খাদ্য প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান ফিল্ড মিল্ক পাউডার বাল্কে আমদানি করলে শুল্ক ২৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ড্রাই মিক্সড ইনগ্রেডিয়েন্টের শুল্ক ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করা হলেও তা আবার ১০ শতাংশে বহাল রাখা হয়েছে। দেশে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় আমদানির ওপর পাঁচ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের পাশাপাশি ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কারোপ করা হয়েছে। হেপাটাইটিস-সি রোগের ওষুধের কাঁচামাল পাঁচ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। ওষুধের মোড়ক তৈরিতে ব্যবহƒত পিভিসি ফিল্ম ও আনপ্রিন্টেড নাইলন ফিল্মের ওপর আমদানি শুল্ক ১০ থেকে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে।
সিমকার্ড ও স্মার্টকার্ড উৎপাদনে ব্যবহƒত কাঁচামালের ওপর শুল্ক ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এয়ার কন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে ব্যবহƒত কাঁচামাল কোল্ড রোল্ড ও ফ্ল্যাট রোল্ডের ওপর শুল্কস্তর ২৫ থেকে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যাটারিসহ বিভিন্ন শিল্পের মৌলিক কাঁচামাল ন্যাচারাল ব্যারিয়াম সালফেটের শুল্কহার ১০ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া লিফ স্প্রিং আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। সাড়ে ৭০০ ওয়াট ক্ষমতার মোটর তৈরি উৎসাহিত করতে আমদানিতে পাঁচ শতাংশ শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, পাঁচ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ও পাঁচ শতাংশ অগ্রিম ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। টেলিভিশনের ওপেন সেল আমদানিতে পৃথক এইচএস কোড সৃষ্টি করে পাঁচ শতাংশ আমদানি শুল্কও নির্ধারণ করা হয়েছে পাস হওয়া অর্থবিলে।