Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 2:40 am

চালের বাজার মানে এখনও বাবুবাজার

 

পুরান ঢাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হচ্ছে কয়েকটি খাতকে ঘিরে। এসব খাত একদিকে যেমন অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানেও রাখছে ভূমিকা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডভিত্তিক খাতগুলো নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের চতুর্থ পর্ব

 নাজমুল হুসাইন: কৃষকের উৎপাদিত ধান কিনে ব্যবসায়ীরা চাল উৎপাদন করেন। সেই চালের অধিকাংশই গ্রামগঞ্জের আড়ত ঘুরে পৌঁছায় রাজধানীতে। আর বহু বছর ধরেই সংগৃহীত এসব চালের সর্ববৃহৎ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে পুরান ঢাকার বাবুবাজার ও সংলগ্ন বাদামতলী এলাকা। দেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ চালের পাইকারি বাজার বলতে এখনও এটাই। সময়ের সঙ্গে এ চালের বাজারের আকার-আয়তন, ব্যবসা ও ক্রেতার পরিসর বেড়েই চলেছে।

images (2)এখানে শুধু ঢাকা নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের চালের মিল মালিকসহ পাইকারি ক্রেতা-বিক্রেতাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে আসা-যাওয়া রয়েছে। ফলে সারা বছরই ক্রেতা-বিক্রেতার একটা মিলনকেন্দ্র বাবুবাজার-বাদামতলীর এসব চালের আড়ত। আর প্রধান খাদ্যশস্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এখানকার আড়তগুলো সামগ্রিকভাবে দেশের নিরবচ্ছিন্ন চাল সরবরাহে বড় অবদান রাখছে।

পুরান ঢাকার বাদামতলী ও বাবুবাজারের চালের পাইকারি আড়তে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলার পাইকারদের কাছে চালের বেচাকেনার জন্য এসব আড়তই প্রথম পছন্দ। এখান থেকে বিভিন্ন আড়তের প্রতিনিধিরা ও সরাসরি পাইকারদের মাধ্যমে চাল সারা দেশে পৌঁছে যায়। ঢাকার মধ্যে বিভিন্ন বাজারে চালের প্রধান সরবরাহ যায় এখান থেকে।

এছাড়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল, যাত্রাবাড়ী, কারওয়ান বাজার, মালিবাগ, কচুক্ষেত এসব এলাকায় কিছু চালের আড়ত গড়ে উঠেছে। তবে অন্য যে কোনো পাইকারি আড়ত থেকে বাবুবাজারে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা অনেক বেশি।

বাদামতলী-বাবুবাজারের চাল আড়ত মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এ এলাকায় ১৮০ থেকে ১৯০টি নিবন্ধিত আড়ত রয়েছে। সার্বিকভাবে বাবুবাজার ও বাদামতলী দুই বাজারে চালের দোকান দুই শতাধিক ছেড়ে যাবে। চালকলের মালিকের কমিশন এজেন্ট হিসেবেই ব্যবসা করেন অধিকাংশ আড়তদার। প্রতিদিন এসব বাজারের আড়তগুলোয় ৭০ থেকে ৯০ ট্রাক চাল আসে সারা দেশ থেকে। গড়ে ন্যূনতম লক্ষাধিক টাকা কেনাবেচা হয় এক-একটি দোকানে।

এখন বাবুবাজার-বাদামতলী চালবাজারে সর্বাধিক চাল আসে মূলত উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো থেকে। যার মধ্যে নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া, নাটোর উল্লেখযোগ্য। এখানকার প্রতিটি পাইকারি দোকানেরই নির্ধারিত চালের মিল আছে। এ কারণে এখানকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী কমিশন এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে মিল থেকে চাল এনে গাড়িভাড়া ও শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করে আড়তে চাল পৌঁছে দেয় চালকলের মালিকই। আর সিদ্ধ চালের প্রতি কেজিতে চালকলের কাছ থেকে ২৫ পয়সা এবং যে পাইকার কিনবেন, তার কাছ থেকে ২৫ পয়সা হিসেবে মোট ৫০ পয়সা কমিশনে তা কেনাবেচা করেন এখানকার আড়তদাররা।

আবার এসব আড়তে অনেক ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মূল্য ধরে চাল দেন চালকলের মালিকরা। এ চালের কেজি বেশি দরে বিক্রি করতে পারলে লাভ, আর না পারলে লোকসান গুনতে হয় আড়ত মালিককেই। এ বাজারে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ধরনের চাল বিক্রি হয়। প্রত্যেক ধরনের চালের আবার কয়েকটি মান রয়েছে। চালের ধরন ও মানের ওপর নির্ভর করে চালের দাম নির্ধারিত হয়।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার নয়াবাজার থেকে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচের সড়ক ধরে এগোতেই শুরু হয়েছে বাবুবাজার। সড়কের বাঁ পাশে সারি সারি চালের আড়ত। এভাবে আড়তের পরে আড়ত চলে গেছে বাদামতলী ঘাট পর্যন্ত। প্রতিটি আড়তে হাজার হাজার বস্তা চালের মজুত। তবে কয়েক প্রকার চালের নমুনা নিয়ে দোকানের সম্মুখভাবে বসেন আড়তদার। ক্রেতারা সেই নমুনা চাল দেখে কেনাকাটা করেন।

এখানকার চালের ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া রাইস এজেন্সির কর্মকর্তা রঞ্জু হোসেন বলেন, ‘ব্যবসা আর আগের মতো নেই। সেটা এখানকার ব্যবসায়ীদের দোষেই। এখানে এখন সব বাকির খেলা। যারা বাকিতে মাল দিতে পারে, তাদেরই ব্যবসা আছে। যারা পারে না, তারা বসে বসে দিন কাটায়। এতে বড় ব্যবসায়ীরা আরও বড় হচ্ছে। ছোট ব্যবসায়ীরা বন্ধের দিন গুনছে।’

এদিকে আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘বাস্তবিক কারণেই বাদামতলী ও বাবুবাজারের ব্যবসা আগের মতো নেই। আগের থেকে আড়তের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। কারণ ব্যবসা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে সেটা স্বাভাবিক। তবে চালের ব্যবসায় এখনও শীর্ষে রয়েছে বাবুবাজার-বাদামতলী।’

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাবুবাজার-বাদামতলীর চালের বাজার আরও বড় আয়তন লাভ করে। আগের জিঞ্জিরার চালের বাজারও চলে আসে নদীর এপারে। সব মিলিয়ে সে সময় পাইকারি চাল বিক্রেতাদের একচেটিয়া ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয় স্থানটি। ঢাকা শহরের বাজারসহ দেশের প্রায় অধিকাংশ জেলায় এখান থেকে চাল সরবরাহ করা হতো। দক্ষিণাঞ্চলে বরিশাল, পিরোজপুর থেকে শুরু করে অনেক জেলা থেকে চাল কিনতে ভিড় জমাতেন পাইকারি ক্রেতারা। সে সময়টিকে এ বাজারের চাল বিক্রির স্বর্ণযুগ বলেন স্থানীয় অনেক প্রবীণ ব্যবসায়ী।

images (3)তবে বর্তমান বাজারব্যবস্থার ক্রমবৃদ্ধির কারণে এ বাজার হারিয়েছে তার গ্রাহক। ঢাকা শহরের বেশ কিছু জায়গায় একাধিক বড় পাইকারি চালের বাজার গড়ে ওঠায় স্থানীয় পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের বাদামতলী বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা তাদের নিকটবর্তী পাইকারি বাজার থেকে চাল কিনছেন। এছাড়া প্রচুর করপোরেট কোম্পানি চালের বাজারে বিনিয়োগ করে চালকে ব্র্যান্ডিং করছে। তারপরও বেশ কিছু এলাকার চাল ব্যবসায়ী এখনও চাল কেনার জন্য বাদামতলী পাইকারি বাজারকে প্রাধান্য দেন।

বাজারে আসা ক্রেতা সিরাজুল হকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সুনামের কারণে এখনও দেশের অনেক ব্যবসায়ী দেশের প্রাচীন এ পাইকারি বাজারে চাল কিনতে আসেন। এখনও দেশে এ বাজারের বিকল্প কোনো বাজার নেই। দেশের চালের বৃহৎ জোগান নিশ্চিত করতে বড় অবদান রাখছে এ বাজার।

সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যে শুধু স্থানীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি, তা কিন্তু নয়। আমরা বিভিন্নভাবে সরকারকে সহযোগিতা করি। যেহেতু চাল এমন একটি উপাদান, যার দামের ওপরে বাজারব্যবস্থা অনেকটা নির্ভর করে, সেজন্য এ বাজারের অবদান অনেক।’