চালের সংকটে আলুর খোঁজ নেওয়া যেতেই পারে

গোল আলু কৃষকের কাছে গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। কেউ তার খাদ্য তালিকায় গোল আলুকে বেশি প্রাধান্য বা গুরুত্ব দিতে চায় না। রফতানিতেও এই পণ্যের কোনো সফলতা নেই। অধিকন্তু দৈনিক শেয়ার বিজের একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এক ব্যবসায়ী দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যাবেন মালয়েশিয়ায়। এর অর্থ গোল আলু বা খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াকরণের ব্যবসাও হচ্ছে না। অর্থাৎ এ পণ্য ব্যবহার করে শিল্পও হবে না। এসব খবরের অর্থ কী? একটু পেছন থেকে আলোচনাটা শুরু করি। বাঙালি গোল আলু বেশি খেতে চায় না বা পছন্দ করে না। এ অবস্থায় পরিবর্তন গত ৮-১০ বছরেও কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। হলে আজকে চালের যে সমস্যা হয়েছে, তার অনেকটাই লাঘব হয়ে যেত। মনে আছে ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের তত্ত¡াবধায়ক সরকারের কথা। তখন অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, যিনি এখন অনেক কথা বলেন। তখন দেশে ভীষণ সংকট হয় চালের। দেশের বাজারে চালের অভাব। দাম হু-হু করে বাড়ছে। অতএব চাল আমদানির আয়োজন করা হলো। কিন্তু ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও ভারত, যারা চাল রফতানি করে তাদের অফুরন্ত চাল নেই। ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। এ অবস্থার ওপর অনেক লিখেছি, আমার মনে আছে। আরও মনে আছে ‘সংগীতের রানি’ মমতাজ বেগমের কথা। তাকে দিয়ে গান গাওয়ানো হলো। টেলিভিশনে প্রচার হতো সেই গান। বিষয়বস্তু? বিষয়বস্তু গোল আলু। চাল নেই, এতে কোনো সমস্যা নেই। আসুন সবাই গোল আলু বেশি বেশি খাই। আমাদের খাদ্য তালিকায় বেশি করে গোল আলুকে জায়গা করে দিই। কী সুন্দর গান, কী সুর, কী গায়কী! চালের ওপর চাপ কমাতে গোল আলুর ব্যবহার। কিন্তু ফলাফল? বাঙালি কি গোল আলুকে আগের চেয়ে বেশি আদর করে তার খাবার টেবিলে স্থান করে দিয়েছে? আমার মনে হয় না। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, বিগত ৮-১০ বছরে কত কিছুর পরিবর্তন হলো; কিন্তু গোল আলুর কদর সেভাবে বাড়েনি। ৮-১০ বছর আগেও প্রচুর গোল আলু হিমাগারে ছিল, তা পচেছে। এবার খবরে দেখলাম, ৪০-৪৫ লাখ টন গোল আলু হিমাগারে পড়ে আছে। ক্রেতা নেই। ২০১৬ সালে গোল আলু উৎপাদিত হয়েছে ৮০ লাখ টন। ২০১৭ সালে হয়েছে এক কোটি টন। সামনে শীতকাল। বগুড়া ও বিক্রমপুরের কৃষকরা গোল আলু ঘরে তুলবেন। কত গোল আলু? জানি না। মরবেন না তো কৃষকরা? হিমাগারের ৪০-৪৫ লাখ টন গোল আলুর মধ্যে ১০-১৫-২০ লাখ টনও যদি খরচ হয়, তাহলেও কিন্তু প্রচুর স্টক। তার ওপর নতুন আলু। দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা, অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটছে হিমাগার মালিকদের। দুশ্চিন্তায় কৃষকরা। কী বিপদ। গোল আলুর বাজার পাওয়া যাচ্ছে না, চাহিদা বাড়ছে না। রফতানিও করা যাচ্ছে না। ব্যাংকের টাকা আটকা পড়ছে। অথচ চালের চেয়ে কম খরচে প্রচুর গোল আলু উৎপাদন করা যায় বলে কৃষক এটি চাষ করে। এটিকে সাধারণ মানুষ একটু কদর করলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়Ñসবটা না হোক, কিছুটা। সবাই ভাত চায়। তাও কী, আজকাল দেখা যায় সবাই সরু চাল চায়। যাদের আয় কম, এমন কী আমি জানি, ড্রাইভার শ্রেণির লোকেরাও নাজিরশাইল চাল খায়। একশ্রেণির ব্যবসায়ী এ সুবাদে মোটা চাল সরু করে যন্ত্র দিয়ে। লাভই লাভ। ব্যাংকের টাকা দিয়ে ‘এলসি’ করে ওই যন্ত্র বিদেশ থেকে আনা হয়। চাহিদা আছে বলেই তা হয়। অথচ দেশে সরু চাল বেশি হয় না। কিন্তু এর চাহিদা বাড়ছে। মানুষ সিদ্ধ চাল চায়। সরকার আতপ চাল ওএমএস-এ বিক্রি করলে মানুষ তা নিতে চায় না। এদিকে দিনদিন বাড়ছে গমের চাহিদা, আটা ও ময়দার চাহিদা। যে মানুষ ১৯৭২-৮০ সালের দিকেও আটা খেতে চাইত না, সেও আজ আটার রুটি অন্তত এক বেলা খায়; কেউ কেউ দুই বেলা। অনেকে আজকাল ময়দার রুটিও খায়। অথচ দেশে গম হয় না। যা হয়, তা অতি সামান্যÑউত্তরবঙ্গে। ফলে বছরে ৪০-৪৫ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। লাগে প্রচুর টাকা। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে। চাল থেকে আটায়, ময়দায়। গোল আলুতে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। সবাই লাল গোল আলু পছন্দ করত। ময়মনসিংহ ও বগুড়ার লাল আলু। বড় বড় গোল আলু ১৯৭৫-৮০ সালের দিকেও মানুষ পছন্দ করত না। হিমাগারের আলু তো বটেই। হিমাগারের গোল আলু আবার মানুষে খায়? না, এখন মানুষ খায়। মুশকিল হচ্ছে, তা অল্প পরিমাণে। সবজির দিকে মানুষের নজর বেড়েছে। ফলমূলের দিকে দৃষ্টি যাচ্ছে। কিন্তু অধিকতর পরিমাণে গোল আলু গ্রহণের প্রবণতা দেখা যায় না। এটা আমার ধারণা, অভিজ্ঞতা। লাল গোল আলুর ভর্তা সরিষার তেল দিয়ে কী মজা! এটা বড় বড় গোল আলুতে হয় না। কিন্তু গোল আলুতে তো ‘ফ্রেঞ্চফ্রাই’ হতে পারে। ছেলেমেয়েরা তা পছন্দ করতে পারত। কিন্তু না, আমাদের নতুন প্রজন্মের দৃষ্টি এসবে নেই। তাদের নজর ফাস্টফুডে পিৎজা, দোসা এবং এ ধরনের বিদেশি স্টাইলের খাবারে। জানি না এসব কেন হচ্ছে। বিপণনের অভাবে, ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে, বিনিয়োগের অভাবে, প্রচারের অভাবে? বলা খুবই মুশকিল। কিন্তু যা বোঝা যাচ্ছে গোল আলু কম দামে পাওয়া যায়, চাল বেশি দামে; কিন্তু তাও চালের সংকট হয় মাঝেমধ্যেই। এবারের সংকট হয়েছে দুই বন্যায়। ২০ লাখ টন চাল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে। ধানের জমি নষ্ট হচ্ছে। অবকাঠামো, বাড়িঘর এবং নানা কারণে ধানিজমি নষ্ট হচ্ছে। ভ‚উপরিস্থ জল, ভ‚গর্ভস্থ জল কমে আসছে। নদীনালার জল কমে আসছে। জলনির্ভর বোরো ফসল তাই কত দিন চলবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। গোল আলু উৎপাদনে কি এ সমস্যা আছে? মনে হয় না। আরেকটি বিষয় হতে পারতÑঠিক আছে, গোল আলু হলো। তা রফতানি করব বেশি বেশি। সেই টাকায় চাল ও গম আমদানি করব। না, তার ব্যবস্থাও নেই। ২০১৭ সালে জানতে পারলাম, এক লাখ টন গোল আলুও রফতানি করা যায়নি। কে দায়ী এজন্য? জানি না। দায়িত্বের প্রশ্নে আমাদের সোনার বাংলা নিশ্চুপ বরাবর। কৃষিতে যত্ন করলে আলুসহ আরও অনেক ধরনের হাইভ্যালু প্রডাক্ট করা যায়। মানুষ চাষের জিনিস খেতে চায় না। প্রাকৃতিক সারের জিনিস খেতে চায়। এজন্য তারা মূল্যও দিতে প্রস্তুত। হাইভ্যালু প্রডাক্টের বিদেশেও চাহিদা প্রচুর। আমরা বিদেশে কিছু শাকসবজি রফতানি করি। কিন্তু এর থেকে আয় খুবই কম। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৮ কোটি ডলার। এটা কিছুই না। এক কোটি বাংলাদেশিই বিদেশে বসবাস করে। তাদের জন্যই দরকার প্রচুর কৃষিপণ্য। তাছাড়া পৃথিবীর বহু দেশেই হাইভ্যালু কৃষিপণ্যের দাম বেশি এবং মানুষ তা খুশিতে কেনে। কাঁচাবাজারে দুই ধরনের শসা একটা দেশি, অন্যটা চাষের। প্রচুর সংখ্যক লোক বেশি দাম দিয়ে ‘দেশি’ শসাটাই কেনে। মাছের বেলাতেও তাই ‘দেশি’ মাছের দাম খুবই বেশি। তারপরও ক্রেতা আছে। যে কোনো ধরনের দেশি মাছের ক্রেতার কোনো অভাব বাজারে দেখা যায় না। আমি যা বলতে চাইছি তা হচ্ছে, কৃষিতে নতুন ধারণা-ভাবনার দরকার। চালে সাফল্য অনেক। তবে দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতি আমাদের বিপদে ফেলে দিতে পারে। এবার বলা যায়, সামান্য দুটো বন্যা আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছে। চালের অভাব সেভাবে হয়নি। বাজারে চাল আছে। লোকেরও ক্রয়ক্ষমতা আছে বলে দৃশ্যমান। তবে বন্যা-উপদ্রæত এলাকার কথা একটু ভিন্ন। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করে ফেলেছে চাতাল ও মিলমালিকরা। তারা অন্য দল থেকে সরকারি দলে এসে ভালো ব্যবসাই করে ফেলে। চালের দাম ভীষণভাবে বাড়ায়। এটা সংকটের পূর্বলক্ষণ ছিল। আমার কথা, আমদানি বৃদ্ধি, সরবরাহ বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার সমস্যা সামাল দিচ্ছে। কিন্তু এখানে শিক্ষা একটা। প্রকৃতি ক্ষতি করতে না পারে, এমন সব পণ্যের দিকে যেতে হবে। যেমন বন্যায় জলের সঙ্গে সঙ্গে ধান গাছও মাথা উঁকি দিয়ে বড় হবে। জল যেহেতু নেই, তাই জল কম লাগে এমন পণ্যে যেতে হবে। এসব আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা জানেন। আমি আর আলোচনায় যেতে চাই না। তবে ক্ষোভের বিষয়টি জানিয়ে আজকের নিবন্ধ শেষ করতে চাই। যে গোল আলুর প্রতি মানুষের এত অনাগ্রহ, তা প্রক্রিয়াজাত করা যায়। কেউ কেউ করছেও। আজকাল টেকনোলজি এমন হয়েছে যে, অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, যারা কাজটি করবেন, যে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা এ কাজটি করবেন, তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। শেয়ার বিজের খবরে দেখলাম, ঢাকায় একটি প্রদর্শনী হচ্ছে। এর নাম : ‘শোকেস মালয়েশিয়া-২০১৭’। এর উদ্বোধন করেছেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। সেখানে খোলাখুলিভাবে মালয়েশিয়ার একটি ফার্ম অর্থ পাচারের কাজ করছে। ওই সেই ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্প। কত টাকা দিলে মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়া যায়, তার একটা হিসাবও সেখানে পাওয়া যায়। ওই সেকেন্ড হোম প্রকল্পে শীর্ষে আছে চীনারা। তারপর জাপানিরা। ওই প্রকল্পে নাগরিকত্ব নিয়েছে তিন হাজার ৫৪৬ জন বাংলাদেশি। দেখা যাচ্ছে, এবার ওই প্রদর্শনীতে খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এক ব্যবসায়ী বলছেন, ‘দেশে বর্তমানে মুক্তভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো পরিবেশ নেই। সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকলে প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এ অবস্থায় নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।’

 

অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক

সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০