ইসমাইল আলী: দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি, যদিও চাহিদা থাকছে ১০ থেকে ১১ হাজার মেগাওয়াট। করোনায় তা আরও কমে গেছে। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি মালিকানায় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সৈয়দপুরে আরও একটি ১৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে চীন থেকে নেওয়া হচ্ছে কঠিন শর্তের ঋণ (বায়ার্স ক্রেডিট)। আর ডিজেলচালিত এ কেন্দ্রটির উৎপাদন ব্যয় পড়বে অনেক বেশি। এছাড়া সিম্পল সাইকেল হওয়ায় এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রযুক্তিও বেশ অদক্ষ। ফলে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালন ব্যয় পড়বে অনেক বেশি।

সূত্রমতে, সৈয়দপুরে নির্মিতব্য এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় এক হাজার এক কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল দেওয়া হবে ৩০২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ও পিডিবি দেবে ২১৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আর কঠিন শর্তের ঋণ (বায়ার্স ক্রেডিট) নেওয়া হবে ৪৮৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের অর্ধেকেরও কম। রাষ্ট্রীয় (সভরেন) গ্যারান্টির বিপরীতে এ ঋণ দিচ্ছে ব্যাংক অব চায়নার সিচুয়ান শাখা। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করবে চীনের ডংফেং ইলেকট্রিক ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে চুক্তি বা ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) মূল্য চার কোটি দুই লাখ ৫৫ হাজার ইউরো, এক কোটি ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার ডলার ও ৪৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা (দেশীয় মুদ্রা)। এর ৮৫ শতাংশ তথা তিন কোটি ৮৬ লাখ ১০ হাজার ইউরো ও এক কোটি ২২ লাখ ১০ হাজার ডলার ঋণ দেবে ব্যাংক অব চায়না। আর তিন বছর গ্রেস পিরিয়ড শেষে ১২ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
এ ঋণের সুদহার ধরা হয়েছে দুই ধরনের। এর মধ্যে ইউরো অংশের ঋণের জন্য ছয় মাস মেয়াদি ইউরো আন্তঃব্যাংক অফার রেটের (ইউরিবর) সঙ্গে দুই শতাংশ সুদ যোগ করে যে হার হয়, সে হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে। আর ডলার অংশের ঋণের জন্য ছয় মাস মেয়াদি লন্ডন আন্তঃব্যাংক অফার রেটের (লাইবর) সঙ্গে দুই দশমিক ৮০ শতাংশ সুদ যোগ করে যে হার হয়, সে হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর বাইরে ঋণের পরিমাণের এক শতাংশ অ্যারেঞ্জমেন্ট ফি, প্রতি বছর যে পরিমাণ ঋণ ছাড় হবে না তার ওপর দশমিক ৮০ শতাংশ হারে কমিটমেন্ট ফি এবং মূল ঋণ ও সম্ভাব্য সুদের হারের ওপর পাঁচ দশমিক ৫৬ শতাংশ হারে ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম ফি পরিশোধ করতে হবে।
এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য গৃহীত ঋণের গ্র্যান্ট এলিমেন্ট দাঁড়িয়েছে মাত্র সাত দশমিক ৬০ শতাংশ। যদিও দেশে প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণের গ্র্যান্ট এলিমেন্ট ৩৫ শতাংশের কম হলেই তাকে কঠিন শর্তের ঋণ ধরা হয়। আর এ ধরনের ঋণের জন্য নন-কনসেশনাল ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটির অনুমোদন নিতে হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবটি গত বছর অনুমোদন দেয় নন-কনসেশনাল ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটি।
জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, সৈয়দপুরে বিদ্যমান ২০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রের পাশেই ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হবে। এজন্য জমি খুব বেশি লাগবে না। মূলত দেশের উত্তরাঞ্চলের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আর প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রটির যন্ত্রপাতি চালু ও বন্ধ করার সুবিধার্থে সিম্পল সাইকেল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে করোনার আগেই এ প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। তাই পরে এটি আর বন্ধ করা যায়নি।
তথ্যমতে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিজেই ঋণের সংস্থান (টেন্ডারার ফাইন্যান্সিং) করবেÑএমন শর্ত
রেখে সৈয়দপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এজন্য দরপত্রে বায়ার্স ক্রেডিটের ঋণের কয়েকটি শর্ত রাখা হয়। এগুলো ছিল তিন বছর গ্রেস পিরিয়ড-পরবর্তী কমপক্ষে ১০ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ, ঋণের পরিমাণ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের ইপিসি মূল্যের ন্যূনতম ৮৫ শতাংশ হবে এবং ঋণের ১০ শতাংশ অগ্রিম প্রদান করতে হবে ঠিকাদারকে।
দরপত্রে আটটি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে চীনের প্রতিষ্ঠানই ছিল ছয়টি। বাকি দুটি ছিল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান। দরপত্র মূল্যায়নশেষে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় চীনের ডংফেং ইলেকট্রিক ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনকে। দরপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া ঋণ প্রস্তাবটি পরে অনুমোদন করে নন-কনসেশনাল ঋণবিষয়ক স্থায়ী কমিটি।
যদিও এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো ছিল ডিজেলচালিত ও সিম্পল সাইকেল। ফলে এগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ত প্রতি ইউনিট ২৮-৩০ টাকা। সৈয়দপুরের কেন্দ্রটিও একই ধরনের হওয়ায় এতেও উৎপাদন ব্যয় পড়বে অনেক বেশি। আর করোনার কারণে এখন বিদ্যুতের চাহিদা অনেক কমে গেছে। বিভিন্ন কেন্দ্র বসিয়ে রাখা হচ্ছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বন্ধ করে দেওয়ার কথা হচ্ছে। তাই সৈয়দপুরের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পিডিবির লোকসানের বোঝাই বাড়াবে।