নিজস্ব প্রতিবেদক
চা সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন ধারণাটি বলছে, ১৭৩৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনের সম্রাট শেন নাং চা পাতার নির্যাসে আশ্চর্যজনক উদ্দীপন আবিষ্কার করেন। এরপর চা পাতার ভেষজ গুণাবলি নিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন তিনি। পরে তার লেখা বইতে চায়ের ৭২ প্রকার বিষয়কে নির্বিষ করার ক্ষমতা উল্লেখ করা হয়। সেখান থেকেই চায়ের গল্প শুরু। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে চা ইউনান থেকে সারা চীনে ছড়িয়ে পড়ে। তখন চীনের বিভিন্ন প্রদেশের রাজ দরবারে মদ্যপানের স্থলে চা পানের নির্দেশ দেওয়া হয়।
আর বাংলাদেশের চায়ের ইতিহাস ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। এ দেশে প্রথম ব্রিটিশ ধনকুবেদের দুটি কোম্পানি চালু করেন। একটি আসাম টি কোম্পানি ও অন্যটি ইস্ট ইন্ডিয়া টি কোম্পানি। ১৮৪০ সালে তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রথম পরীক্ষামূলক চা-বাগান ছিল চট্রগ্রামে। আর ১৯৫৪ সালে প্রথম বাণিজ্যিক চা-বাগান সিলেটের মালনীছড়ায়। সে থেকেই শুরু। তখনই এখানে উৎপাদিত চা কলকাতায় নিলামে বিক্রি হতো, যা যেত ইউরোপে।
চায়ের এসব গল্প শোনাতে দেশে আয়োজন করা হয়েছে চা প্রদর্শনী। দেশীয় চা-শিল্পের দেড়শ বছরের ইতিহাসে এমন প্রদর্শনী এটাই প্রথম। গতকাল বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটিতে বাংলাদেশ চা বোর্ডের আয়োজনে তিন দিনব্যাপী এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। চলবে আগামীকাল পর্যন্ত। এ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় চা-বাগান, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণনকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠান ও চা সংশ্লিষ্ট সরকারিসহ দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানসহ অনেকেই।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রদর্শনী ঘুরে দেখা গেছে, চায়ের গল্প, চায়ের আমেজ ও চায়ের ব্যাপ্তি কথা রয়েছে সারা প্রদর্শনীজুড়েই। মেলায় হাতে হাতে ঘুরছে নানা প্রকারের চা, সে গন্ধেই মৌ মৌ করছে পরিবেশ। একেবারেই প্রথম স্তরে টিএসসি মোড়ের চা বিক্রেতাও রয়েছে সেখানে। রয়েছে চা তত্ত্বাবধায়নকারী চা বোর্ডের স্টল ও চা নিয়ে গবেষণাকারী ইনস্টিটিউটের সব অবদানের প্রদর্শনী।
চা বাগান ও চা প্রক্রিয়াকরণে যন্ত্রাংশের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের ভিক্সম ইন্ডিয়া লিমিটেড। মেলায় কথা হয় কোম্পানিটির সিইও ইকবাল কে. চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমানে ভারত এখন সারা বিশ্বের উন্নতম চা প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী। বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন যাবৎ তারা চায়ের বৃহৎ বাজারে যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে।
প্রদর্শনীতে সাড়া কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের শত শত যন্ত্রাংশ রয়েছে, যা অনেক বাংলাদেশি কোম্পানি জানে না। আমরা সেসব প্রদর্শনীর সুযোগ পাচ্ছি। ফলে প্রদর্শনী ফলপ্রসূ হয়েছে।
শুধু ভারতের এ কোম্পানিই নয়, যন্ত্রাংশের পসরা রয়েছে দেশের কোম্পানিগুলোরও। এ ধরনের প্রায় আধা ডজন কোম্পানি রয়েছে এ প্রদর্শনীতে। এমনই চায়ের বাগানে সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে সেচ দেওয়ার সরঞ্জাম প্রদর্শনী করছে নাভানা গ্রুপের নাভানা রেনেয়বেল এনার্জি লিমিটেড। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে চা বাগানে সেচ দেওয়ার সব ধরনের সরঞ্জামের পসরা সাজিয়ে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি।
মেলা ঘুরে একপ্রান্তে অর্গানিক চায়ের বড় প্রদর্শনী চোখে পড়ে কাজী অ্যান্ড কাজী টি এর প্যাভিলিয়নে। দেশে বাজারসহ বিদেশে তারা ব্ল্যাক টি, ফার্স্ট ফ্লাশ টি, অর্থোডক্স ব্ল্যাক টি, গ্রিন টি, জেসমিন গ্রিন টি, অর্থোডক্স গ্রিন টি, তুলসি টি, জিঞ্জার টি ও মেডলি টি বিক্রি করছে। ফ্রিতে এসব ধরনের চায়ের স্বাদ গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।
কার্যক্রম নিয়ে জানতে চাইলে কাজী অ্যান্ড কাজী টি এর সিইও শোয়েব আহমেদ বলেন, ‘দেশের প্রথম অর্গানিক চায়ের উদ্যোক্তা তারা। পঞ্চগড়ে পাঁচ হাজার একর চায়ের বাগানে সম্পূর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে এসব চা প্রস্তুত হচ্ছে, যা দেশের বাজারের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা হয়।
এইচআরসির প্যাভিলিয়নে বর্তমানে ব্ল্যাক টির বাজার সম্পর্কে কথা হয় এইচআরসি গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার আতিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমানে শীর্ষ চায়ের বাজার দখলে রয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপ। তাদের বাজারে শেয়ার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। পরে অবস্থানে রয়েছে আবুল খায়ের। আর তৃতীয় স্থানটি ধরে রেখেছি আমরা।
বিদেশি কোম্পানি ডানকান গ্রুপ এ দেশে ১৫টি চা বাগানে প্রতি বছর এক কোটি ৪০ লাখ কেজি চা উৎপাদন করে। তারাও রয়েছে প্রদর্শনীতে। তবে একটু আলাদা মনে হলো তাদের পণ্যের পসরা। কারণ চায়ের পাশাপাশি তাদের প্যাভিলিয়নে রয়েছে তাদের দুস্থ চা শ্রমিকদের হাতে তৈরি পণ্যের সমাহার। যার মধ্যে টি ন্যাপকিন, টি টেবিল ক্লথ, টি টেবিল রানার, টিস্যু বক্স রয়েছে।
গ্রুপটির চাতলাপুর চা বাগানের ম্যানেজার ইফতেখার এনাম বলেন, ডানকান সেলফ হেলফ সেন্টারের মাধ্যমে আমাদের দুস্থ চা শ্রমিকরা এসব পণ্য উৎপাদন করেছে। প্রচলিত পণ্যের পাশাপাশি তাদের এসব পণ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে।
অন্যদিকে এখানে নতুন কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। প্রতি কেজি সাড়ে তিন হাজার টাকা মূল্যের রফতানিযোগ্য চা নিয়ে প্রদর্শনীতে এসেছে সদ্য বাজারে আসা কসমো চা। দেশীয় বাজার ও রফতানি বাজারের জন্য পৃথক চায়ের প্যাকেজ রয়েছে বলে জানান নতুন এ কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আজমল।
প্রদর্শনীতে রয়েছে চা বিক্রেতারাও। টিএসসি মোড়ে মামুন টি স্টল এখানে চা বিক্রি করেন ১৮ ধরনের। জানতে চাইলে মামুন জানায়, প্রচলিত চায়ের পাশাপাশি সে কলার তৈরি চা, আলু বোখরার চা, আঙুরের চা, আপেলের চা, গুড়ের চা, কাঁচা মরিচের চা, তেঁতুলের চা, বিটলবনের চা বিক্রি করে।
গতকাল বৃহস্পতিবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, চা বোর্ডের চেয়ারম্যান সাফিনুল ইসলাম, বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান আরদাশীর কবির, টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান শান্তনু বিশ্বাসসহ চা শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও চা বাগানের মালিকরাও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন। ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত প্রদর্শনী চলবে বলে আয়োজকরা জানান।
Add Comment