সমতল ভূমিতে চা চাষ কল্পনাও করা যায় না। সেই অকল্পনীয় বিষয়টির বাস্তব রূপ দেওয়া হয়েছে পঞ্চগড়ে। পঞ্চগড়ে পাহাড়, টিলা না থাকলেও প্রচুর বৃষ্টি হয়। এ বৃষ্টিকে কাজে লাগিয়ে চায়ের আরেক মুল্লুক হয়ে উঠেছে জেলাটি। অর্গানিক পদ্ধতিতে উৎপাদন এই চায়ের আরেক বৈশিষ্ট্য।
পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া যাওয়ার সড়কের বামদিকের চা বাগানগুলো মূলত ভারতের মালিকানাধীন হওয়ায় এ অংশে প্রবেশ নিষেধ। শুধু চাবাগান নয়, এখানকার টি এস্টেটের ভেতরের নির্মাণশৈলীও দারুণ নজরকাড়া। পঞ্চগড়ে ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তের মধ্যে চা গাছ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে জেলার ১৬ হাজার একর জমি চা চাষের উপযোগী রয়েছে। এখন পর্যন্ত চা চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে দুই হাজার ২৫৫ দশমিক ৫৫ একর জমিতে।
সিলেটের চা ভ্যালি ও পঞ্চগড়ের চা ভ্যালির মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। সিলেটে পাহাড়-টিলার চা ভ্যালিতে সেট ট্রি হিসেবে ইপিল ইপিল গাছ ব্যবহার করা হয়। অপরদিকে পঞ্চগড়ে সমতলের চা ভ্যালিতে ব্যবহার করা হয় ১৬২ ধরনের হারবাল গাছ। এর মধ্যে রয়েছে নিম, হরিতকি, আমলকী, বহেরা, নিশিন্দা কাঞ্চন, অর্জুন প্রভৃতি।
গোড়ার কথা
তেঁতুলিয়া থেকে দার্জিলিংয়ের দূরত্ব মাত্র ৫০ কিলোমিটার। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে পৃথিবীর সেরা চা; তাহলে পঞ্চগড়ে কেন নয়? এমন চিন্তা থেকে ১৯৯৬ সালে পরীক্ষামূলক চা চাষ হয় তেঁতুলিয়ায়। ২০০০ সালে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি ও কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান চা চাষ শুরু করে। তেঁতুলিয়ার বিস্তীর্ণ গো-চারণভূমি কয়েক বছরের মধ্যেই চায়ের সবুজ পাতায় ভরে যায়। এতে সৃষ্টি হয়েছে চোখ জুড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
অর্গানিক চাষ
এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম পঞ্চগড়ে অর্গানিক পদ্ধতিতে চা চাষ হয়। অর্গানিক চা চাষের বৈশিষ্ট্য হলো, এ চা চাষে কোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় না। চাষের জন্য এখানে গরুর খামার গড়ে তোলা হয়েছে। ডেইরির জৈবসার ব্যবহার করে এখানে সাতটি বায়োগ্যাস প্লান্ট গড়ে উঠেছে। এ প্লান্টের তরল সার অর্গানিক চা চাষে ব্যবহার করা হয়।
রিসার্চ সেন্টার
এখানের কাজী টি এস্টেটে আনন্দধারা নামে একটি গেস্টহাউস আছে, যা দেখতে মনোরম ও প্রকৃতির সঙ্গে মিশে একটি আলাদা পরিবেশ তৈরি করেছে। বর্তমানে এই গেস্টহাউসটি অর্গানিক চা চাষের রিসার্চ সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা বেড়াতে এসে এখানকার পরিবেশ-প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হন। এছাড়া টি এস্টেটগুলোর প্রবেশপথে থাকা বিক্রয়কেন্দ্র থেকে পর্যটকরা বাগানের চা ও চাষকৃত মধু কিনতে পারবেন।
আরও যা আছে
চা বাগানের পাশাপাশি পঞ্চগড়ে রয়েছে বহু প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। জেলার অভ্যন্তরে ভিতরগড়ে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ প্রতœতাত্ত্বিক দুর্গনগরী, মহারাজার দিঘি, পাথরের জাদুঘর তথা রক্স মিউজিয়াম, আটোয়ারীর মির্জাপুরে বারো আউলিয়ার মাজার, শাহী মসজিদ (ইমামবাড়া), দেবীগঞ্জের গোলকধাম মন্দির, তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, পিকনিক স্পট কর্নার, রওশনপুর জেমকন গ্রুপের নয়নাভিরাম শিশু পার্ক ও আনন্দধারা পার্ক, সীমান্তবেষ্টিত ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার সার্চলাইট, মহানন্দা নদী প্রভৃতি।
পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া যাওয়ার পথে ভজনপুরে গরুর মাংস দিয়ে গরম ভাত খেতে পারেন সামান্য টাকায়। এছাড়া আশেপাশে এমন অনেক খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে, যেগুলোতে কম পয়সায় আয়েশ করে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাওয়া যেতে পারে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যাওয়ার জন্য হানিফ কিংবা নাবিল পরিবহনের বাস রয়েছে। ভাড়া ননএসিতে ৬০০ টাকা, এসি এক হাজার ৫০০ ও নরমাল এসি ৯০০ টাকা। এছাড়া বাবলু নামে একটি বাসে ৫০০ টাকায়ও
যেতে পারেন। পঞ্চগড়ে নামার পর তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধাগামী লোকাল বাসে ৪৫ টাকা ভাড়ায় এক ঘণ্টায় তেঁতুলিয়ায় পৌঁছাতে পারবেন। এখান থেকে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো কিংবা পিকনিক কর্নারে রিকশা বা ভ্যান ভাড়া নেবে পাঁচ টাকা। চা বাগান ও কমলা বাগান দেখার জন্য অতিরিক্ত ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় যাতায়াত করা যাবে। এছাড়া বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে বাসযোগে ২০ টাকা এবং সেখান থেকে জিরো পয়েন্টে বিজিবির অনুমতিসাপেক্ষে ৩০ থেকে ৫০ টাকায় ভ্যান বা অটোরিকশায় স্থলবন্দরে যাতায়াত করতে পারবেন।
রাতযাপন
থাকার জন্য পঞ্চগড় শহরে বিভিন্ন মানের বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে বিভিন্ন রকম কক্ষের প্রতিদিনের ভাড়া ১৫০ থেকে ৬০০ টাকা। তেঁতুলিয়ায় কোনো আবাসিক হোটেল নেই। তবে জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে প্রাচীনকালে নির্মিত একটি ডাকবাংলো রয়েছে। এছাড়া অন্য পাশে রয়েছে তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নার। রাত যাপনের জন্য পিকনিক কর্নারে প্রতি কক্ষের ভাড়া ২০০ টাকা। জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর বেলায় ৪০০ টাকা। এসব বাংলোয় থাকার জন্য জেলা পরিষদ সচিব, পঞ্চগড় কিংবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার তেঁতুলিয়ার কাছে আবেদন করে কয়েক দিন আগে থেকেই বুকিং নিতে হয়। এছাড়া বাংলাবান্ধায় রয়েছে দুই কামরার একটি সরকারি বাংলো।
আমিনুল ইসলাম সোহেল