নিজস্ব প্রতিবেদক: চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন শ্রমিক ও খাত বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য মোটাদাগে কিছু কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো, চায়ের নিলামি ব্যবস্থার সংস্কার, চা শিল্পকে একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং নানা ধরনের আইনি সংস্কার। পাশাপাশি এ খাতের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে উন্নত জাতের চা গাছ রোপণের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে।
রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের চা বাগানের শ্রমিকেরা কেন পেছনে পড়ে আছে?’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সংলাপের সভাপতিত্ব করেন সভাপতিত্ব করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের এসডিজি বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে কাউকে পিছিয়ে না রাখা। কিন্তু আমরা দেখছি আমাদের চা শ্রমিকরা মূল ধারার জনগোষ্ঠীর থেকে অনেকখানি পিছিয়ে। তারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন আলোচনায় জায়গা পাচ্ছেন না। তিনি আরও বলেন, চা শ্রমিকদের মধ্যে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা, শিক্ষার অভাব ও নারীর প্রতি সহিংসতার মতো সমস্যার প্রকটতা বেশি। এসব জায়গা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। তাদের পিছিয়ে রেখে আমারা আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারব না।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যদিও বাংলাদেশের চা শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তবুও চা বাগান কর্মীদের এখনও আর্থ-সামাজিক, মানবাধিকার এবং অন্যায্য মজুরি-সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সমাধান করতে হবে।
সংলাপে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সংগঠনের প্রধান খায়রুন আক্তার বলেন, ‘আমাদের চেয়ে রোহিঙ্গারা অনেক ভালো আছে। ১৭০ বছর ধরে জঙ্গলে পাহাড় কেটে বসবাস করেও আমাদের আজ ভূমির ওপর কোনো অধিকার নেই। বর্তমানে আমাদের মজুরি ১৭০ টাকা। আমরা ৩০০ টাকার জন্য আন্দোলনে নেমেছিলাম। দ্রব্যমূল্যের যে অবস্থা, তাতে ১৭০ টাকায় এখনকার বাজারে কিছুই হয় না। তিনি আরও বলেন, ‘এতদিন আন্দোলনের পর আমাদের মজুরি মাত্র ১৭০ টাকা হয়েছে। আমাদের মতো মানুষদের মানুষই মনে করা হয় না। যদি আমাদের মানুষ মনে করা হতো, তাহলে ৩০০ টাকা ধরে মজুরি দেয়া হতো। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন শিক্ষিত হচ্ছে। অথচ তারা কোথাও কোনো ভালো চাকরি পাচ্ছে না। মালিক পক্ষ থেকে বলা হয়, আমাদের নাকি বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। এই সুযোগ-সুবিধাগুলো কী, সে বিষয়ে আমিও কিছু জানি না। তারা যে চিকিৎসা সুবিধার কথা বলেন, সেখানে শুধু প্যারাসিটামল ওষুধ ছাড়া আর কিছুই পাই না।’
নারী চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তিনি আরও বলেন, চা বাগানে নারী শ্রমিক ৮০ শতাংশেরও বেশি। তারা সারাদিন বাগানে কাজ করে। অথচ বাগানে কোনো শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। ফলে সেখানে নারীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এছাড়া গর্ভকালীন ছুটিসহ অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলা রয়েছে।
সংলাপে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গুইন লুইস বলেন, ‘আমরা কোনো দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর কাঠামোর দিকে নজর রাখি এবং
নিশ্চিত করি যে, কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের চা বাগানের শ্রমিকরা অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছেন। আজকের আলোচনায় এসেছে, তাদের শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। সে বিষয়ে অবশ্যই আমরা সামনের দিনে কাজ করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিসংখ্যান বলছে, চা শ্রমিকদের ৫২ শতাংশই বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। এই বিশাল দরিদ্র গোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না। আমারা (জাতিসংঘ) এই বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করব।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অনুমিত হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুস শহীদ বলেন, চা বাগানের শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। চা বাগানের শ্রমিকদের দুর্দশার কথা এরই মধ্যে সরকারের ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে চা বাগানের শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়া একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র হবে বলে আমি মনে করি। তিনি আরও বলেন, এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে চা শ্রমিকদের তাদের অধিকার আদায়ে উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। সংলাপে সুপারিশমালা তুলে ধরে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডির) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চা শ্রমিকদের উন্নয়ন হয়েছে শুধু অবকাঠামোগত দিক থেকে, কিন্তু তাদের মানসম্মত উন্নয়ন হয়নি। বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে তাদের উন্নয়ন দরকার। এর পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা খাতে কীভাবে তাদের আনা যায়, সে বিষয়ে নজর দিতে হবে।