চা-শ্রমিক ও পাহাড়ে আধুনিক ‘ক্রীতদাসের গল্প’

আল আমিন হোসাইন: সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে ধোঁয়া কিংবা অফিসের ক্লান্তিতে আমাদের ভরসা এক কাপ চা, আর কী চাই? টং থেকে দামি রেস্তোরাঁ, ছেলে থেকে বুড়ো চায়ের সঙ্গে সমানভাবে জড়িত। আবার বন্ধুদের সঙ্গে বা প্রিয়জনের সঙ্গে মিষ্টি সময় কাটাতেও চায়ের জুড়ি নেই। চায়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক মধুর হলেও চা-শ্রমিকদের নিষ্পেষিত জীবন ও আর্তনাদের গল্প অনেকেরই অজানা।
দুশো বছরের শাসনামলে ব্রিটিশরা উপমহাদেশে কত নির্মমতার জš§ দিয়েছে, তার কোনো হিসেব নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব নির্মমতার ভুক্তভোগী ছিল দেশের অসহায় মানুষ। বুটের লাথি, চাবুকের আঘাত, অনাহারে মৃত্যুসহ সব ভয়ংকর শাস্তি দেয়া হতো। এত কিছু সহ্য করেও দশকের পর দশক শ্রমিকরা সেখানে কাজ করেছেন। চা-বাগানগুলোয় কাজের জন্য প্রয়োজন হতো প্রচুর শ্রমিক। স্থানীয় মানুষজন এসব পরিশ্রমের কাজ করতে চাইত না। তাই দূরদূরান্ত থেকে উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে ধরে আনা হতো শ্রমিকদের, যাদের আর কখনোই ফেরত যেতে দেয়া হতো না।

দারিদ্র্যপীড়িত ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, মাদ্রাজ, দার্জিলিংসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধরে নিয়ে আসা হতো কাজের জন্য। এছাড়া তারা উন্নত জীবনের লোভে পড়ে ব্রিটিশদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে পাড়ি জমাত আসামে। নিম্নবর্ণের এই লোকদের দেখানো হয় সুবর্ণ এক ভূমির ঠিকানা। সেখানে সবুজে ঘেরা পাহাড়ের বেদিতে গাছে গাছে সোনার পাতা ধরে, আর সেই স্বর্ণপত্র সংগ্রহ করাই তাদের কাজ। এমন সব কাল্পনিক ও রূপকথার গল্প শুনিয়ে অনাহারে ভুগতে থাকা লোকেদের আকৃষ্ট করা হতো। এসব মানুষ প্রলোভনে পড়ে যখন বন-জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ে এলেন, তখনই বাস্তবতা বুঝতে পারলেন। বন-জঙ্গলের হিংস্র প্রাণী ও বিষাক্ত পোকামাকড়ের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকতে হতো তাদের। মালিকের দেয়া ছোট্ট এক মাটির কুটিরে পরিবারসমেত বসবাস করতে হতো। দিনের পর দিন বৃষ্টিতে ভিজে অনাহারে দিনাতিপাত করতে হতো। পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়া হতো না কোনো অর্থ। টি-টোকেন নামক এক ধাতব পত্র দেয়া হতো, যার মাধ্যমে শুধু বাগানের মধ্যে নির্ধারিত দোকান থেকেই পণ্য কেনা যেত। বাগানের বাইরে এ টোকেনের কোনো মূল্য ছিল না। ফলে চাইলেই শ্রমিকরা বাইরে যেতে বা কিছু কিনতেও পারতেন না। তাদের জীবন বাঁধা পড়েছিল একটি চা-বাগানের মধ্যে, যাদের কাঁধে ভর করেই ব্রিটিশরা এদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ব্রিটেনে পাচার করতে সক্ষম হয়েছিল। তেমনই এক নির্মম উপাখ্যান রচিত হয় ১৯২১ সালে। নির্মম সেই ঘটনাটি ঘটে চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটে রাতের আঁধারে। মাতৃক্রোড়ের শিশু থেকে শুরু করে স্ত্রী, পুরুষ, বৃদ্ধÑকাউকেই বেয়নেট ও নির্বিচারে গুলির আঘাত থেকে রেহাই দেয়া হলো না। অনেককে নদীতে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়। শত শত লাশ মেঘনা নদীতে ভাসতে দেখা গেল। যে মেঘনার জল চা-শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, সেই মেঘনাপাড়ে এর কোনো স্মৃতিচিহ্ন বর্তমানে রাখা হয়নি, একটা স্মৃতিস্তম্ভও। ভারতবর্ষে ৭০ বছরের চা-শিল্পের ইতিহাসে শ্রমিকরা তখন নির্যাতিত-নিপীড়িত অবস্থার চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল।

বর্তমানে চা উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ অষ্টম। নিবন্ধিত চা-বাগানের সংখ্যা ১৬৮টি। প্রশ্ন রয়ে যায়, বৃহৎ রপ্তানিকৃত ফসল হওয়া সত্ত্বেও চা-শ্রমিকরা কেন এত মানবেতর জীবন-যাপন করেন?
২০২২ সালে চা-শ্রমিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মজুরি ৫০ টাকা বাড়িয়ে ১৬৮-১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে প্রথম শ্রেণির শ্রমিক দিনে ১৭০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণির শ্রমিক ১৬৯ টাকা ও তৃতীয় শ্রেণির শ্রমিক ১৬৮ টাকা মজুরি পান। তাহলে প্রথম শ্রেণির শ্রমিকের মাসিক আয় দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ১০০ টাকা। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, অন্যদিকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, চিকিৎসার খরচ দিয়ে কীভাবে পার হয় একজন চা-শ্রমিকের জীবন?

অন্য শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ১০ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি থাকলেও চা-শ্রমিকরা এ ছুটি পান না। সেখানে চা-শ্রমিকরা এক দিনের ছুটি পান ২২ দিন কাজ করে। একজন চা-শ্রমিক ৪০ বছর বা তারও বেশি সময় চা-বাগানে কাজ করে গেলেন, অথচ কর্মজীবনের শেষে কোনো গ্র্যাচুইটি পান না।
চা-পাতা তোলার কাজে এগিয়ে মেয়েরাই। অনেকেই গর্ভবতী অবস্থায় কাজে নিয়োজিত থাকেন। এমন পরিস্থিতি যে কারও সন্তানের জšে§র সময় প্রসববেদনা উঠলে যাতায়াত ও ভালো হসপিটাল না থাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাদের কোনো মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয় না।
অতিরিক্ত কাজের পারিশ্রমিক দেয়া হয় না বললেই চলে। কাজের যথাবিধি সময় নির্ধারণ না করার ফলে তাদের ১৪-১৫ ঘণ্টার মতো কাজ করার প্রয়োজন হয়। চা-মালিকদের নির্যাতন সহ্য করে ব্রিটিশকাল থেকে নতুন বাংলাদেশে এভাবেই টিকে আছেন নিপীড়িত চা-শ্রমিকরা। এখন সময় এসেছে পালাবদলের।
শ্রম আইন অনুযায়ী, চা-শ্রমিকদের গৃহায়ন, শিক্ষা, বিনোদন, চিকিৎসা প্রভৃতি মৌলিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা বাগান মালিকদের দায়িত্ব। কিন্তু বাগান মালিকরা সেটা কি করেন? দু-একজন বাগান মালিক ছাড়া এটা আর কেউ করেন না।

বাংলাদেশের চা-শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন দরিদ্র এবং পেছনে পড়ে থাকা জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন ভাষা, জাতি-পরিচয়, ধর্ম, সংস্কৃতি ও একটি বিশেষ পেশা অবলম্বন করে বেঁচে থাকা মানুষ তারা। তারা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও পেছনে পড়ে আছেন। তাদের জীবনমান উন্নয়নে সমান সুযোগ-সুবিধাই যথেষ্ট নয়; দরকার আরও বেশি কিছু। কাজেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চা-শ্রমিকদের প্রতি সুবিচার করতে হলে প্রথমেই শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালা তাদের যেসব অধিকার দেয়, সেসব নিশ্চিত করতে হবে। এরপর সামাজিক নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র তাদের জন্য যে বরাদ্দ রেখেছে, তা আরও বাড়াতে হবে। ভূমির মালিকানাবঞ্চিত চা-বাগানে ‘বাঁধা পড়া’ এসব মানুষের জন্য আরও অনেক কিছু করার আছে তাদের নিয়োগদাতা, রাষ্ট্র ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং বৈচিত্র্যময় জাতি-পরিচয় বাঁচিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যা যা করা সম্ভব, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সেসব ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সামাজিক ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক সুরক্ষাই পেছনে পড়ে থাকা চা-শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজনকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০