শুভ্র শচীন, খুলনা: চিংড়িশিল্পের অনিশ্চয়তা কাটছে না। বহির্বিশ্বে চিংড়ির দাম কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। অভ্যন্তরীণভাবেও নানা জটিলতায় পড়েছেন রফতানিকারকরা। ফলে লোকসান পুষিয়ে নিতে কম মূল্যে গলদা কিনছেন তারা। খোলা বাজারেও বিক্রি হচ্ছে গলদা চিংড়ি। মূল্য হ্রাসে রেকর্ড করায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গলদাচাষিরা লোকসান গুনছেন।
মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও যশোর জেলায় দশ লক্ষাধিক চিংড়িঘের রয়েছে। ঘেরে ভাইরাস ও নানা রোগের প্রকোপ মোকাবিলা করে যখন বাজারজাতকরণের সময়, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অর্ধেক মূল্যে চিংড়ি বিক্রি করা হচ্ছে। গতবছর যে গলদা কেজিপ্রতি বিক্রি করা হয়েছে ৮০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়, একই সাইজের গলদা এ বছর প্রতিকেজি বিক্রি করা হচ্ছে মাত্র ৫০০ থেকে সাড়ে ৬০০ টাকা দরে। আবার অনেক সময় ক্রেতাদের কাছে বাকিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। দিঘলিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এইচএম বদরুজ্জামান জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রার দরপতন ঘটায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে মাছ কেনাবেচায় নতুন ও পুরোনো নিয়মের জটিলতাও এক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে।
খুলনা বিভাগের মধ্যে গলদা চিংড়ি চাষে ডুমুরিয়া প্রথম স্থানে। এখানে প্রায় ২৫ হাজার গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। কৃষকরা গলদা চিংড়ি চাষে অধিক লাভবান হয়ে ঘের ব্যবসায়ে ঝুঁকে পড়েছিলেন। সেই স্বপ্ন আজ ফিকে হতে চলেছে।
ডুমুরিয়ার চাষিরা জানান, জমির লিজের টাকা, মৎস্য খাবার, পোনা ক্রয়, পাহারাদারের বেতনসহ প্রতিকেজি গলদা উৎপাদনের খরচ বিক্রয়মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ঘের মালিকদের লিজের টাকা দিতে পারছেন না তারা। যদি অবস্থার পরিবর্তন না হয় তাহলে তারা আর গলদার চাষ করবেন না। গতবছর যে গলদার দাম এক হাজার ৩০০ টাকা ছিল, এ বছর সে গলদার দাম সাড়ে ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা।
সূত্রমতে, ভাইরাসমুক্ত পোনার সংকট, চিংড়ির ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, উৎপাদনে কারিগরি জ্ঞানের অভাব ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধিতে আর্থিক ক্ষতির মুখে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন উপক‚লের ১০ লাখ চিংড়িচাষি। চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে এরই মধ্যে অনেক ঘেরমালিক গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এছাড়া চিংড়িতে অপদ্রব্য-পুশ মহামারির রূপ নিয়েছে। এতে চিংড়ির গুণগত মান যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির কদরও হারিয়ে যেতে বসেছে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৪ হাজার ৯৩৫টি ঘের রয়েছে। এ বছর ৬৬ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। গতবছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। তবে উৎপাদন হয়েছিল ২৬ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। এবার উৎপাদন ভালো, তবে মূল্য হ্রাসে চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম জানান, সারা দেশের উৎপাদিত বাগদা ও গলদার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদিত হয় সাতক্ষীরায়। এবার বাজারমূল্য কম হওয়ায় চাষিরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। বাগেরহাটে সাদা সোনা-খ্যাত গলদা চিংড়ির দাম কেজিতে ৩০০ টাকার বেশি কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন জেলার ৪৩ হাজার চিংড়িচাষি।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জিয়া হায়দার জানান, জেলায় প্রায় ৪৩ হাজার চাষি প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করেন। দাম পড়ে যাওয়ায় সবাই বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন। যুক্তরাজ্যসহ আমদানিকারক দেশগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চিংড়ির দাম পড়ে গেছে বলে রফতানিকারকরা দাবি করছেন। তাছাড়া বছরের এ সময়টায় চাষিরা ঘের প্রস্তুত করার জন্য সব চিংড়ি ধরে বিক্রি করেন। রফতানিকারকরা মাছের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার এ সুযোগটা অনেক সময় কাজে লাগান বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশে ৯০টি চিংড়ি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে খুলনায় ৫৬টি থাকলেও চালু রয়েছে ৩০টি। দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলেও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি আমদানিতে অনীহা বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে এ শিল্পে।
অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও আছিয়া সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তারিকুল ইসলাম জহির বলেন, গলদা রফতানিতে বর্তমানে একটা স্থবির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গলদার চাহিদা কমে যাওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারগুলোতে। কবে নাগাদ এ অবস্থার অবসান হবে, তা এই মুহূর্তে বলা অসম্ভব।