চিকিৎসকদের দেয়া ‘গিফটে’ অবৈধ রেয়াত নেয় একমি

রহমত রহমান: পুঁজিবাজারে ওষুধ ও রসায়ন খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি একমি ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। জাতীয় ঔষধ নীতিতে ওষুধের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ; কিন্তু ‘প্রমোশনাল আইটেম’ নাম দিয়ে চিকিৎসক, কেমিস্ট ও ড্রাগিস্টদের দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন গিফট, যার আড়ালে প্রচার করছে নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপন। গিফটের তালিকায় টেবিল ল্যাম্প, বেডশিট থেকে শুরু করে রান্নাঘরের ছুরি সবই রয়েছে।

গিফটের আড়ালে কোম্পানিটি নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপন প্রচার করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না ঔষধ প্রশাসন। এসব পণ্য কখনও আমদানি আবার কখনও স্থানীয় বাজার থেকে কিনে তাদের দেয়ার মাধ্যমে নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। শুধু বিজ্ঞাপন প্রচার নয়, এসব গিফটকে উপকরণ দেখিয়ে কোম্পানিটি নিচ্ছে অবৈধ রেয়াত। বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) একমির বিরুদ্ধে প্রমোশনাল আইটেমের বিপরীতে অবৈধভাবে রেয়াত নেয়ার প্রমাণ পেয়ে মামলা করেছে।

এনবিআর-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় ঔষধ নীতি লঙ্ঘন করে ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রমোশনাল আইটেমের আড়ালে বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। প্রমোশনাল আইটেমের পণ্য যখন কোম্পানির বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্যবহƒত হয়, তখন নেয়া অবৈধ। কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মূসক আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান সিনহার ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াইটসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেয়া হলেও তিনি উত্তর দেননি।

পরে এ বিষয়ে একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের কোম্পানি সেক্রেটারি ও মহা-ব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) মো. এরশাদুল কবীর শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়টি বিচারাধীন। আর আমরা এই বিষয়ে লিখিত ও হেয়ারিং দিয়েছি। আপনি সেখান থেকে নেন।’ এর বাইরে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এনবিআর সূত্রমতে, প্রমোশনাল আইটেমের বিপরীতে ওষুধ কোম্পানিগুলো অবৈধ রেয়াত নিচ্ছে বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এলটিইউকে নির্দেশনা দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এলটিইউতে থাকা ওষুধ কোম্পানিগুলোর দাখিলপত্র ও আমদানি তথ্য যাচাই করে এলটিইউ। এতে একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে অবৈধ রেয়াত গ্রহণের বিষয়ে তথ্য পায়। পরে সংশ্লিষ্ট সার্কেল থেকে প্রতিবেদন দেয়া হয়। প্রতিবেদনে একমির ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত আমদানি তথ্য ও দাখিলপত্র যাচাইয়ের তথ্য দেয়া হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এলটিইউ কমিশনার একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর নোটিস জারি করেন। নোটিসে প্রতিষ্ঠানকে শুনানিতে ডাকা হয় এবং অবৈধভাবে নেয়া রেয়াত কেন বাতিল হবে নাÑসে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত আমদানি তথ্য ও দাখিলপত্র যাচাই প্রতিবেদনে বলা হয়, ধামরাই ধূলিভিটা এলাকার একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড এলটিইউ, ঢাকার অধীন একটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির আমদানির তথ্য, দাখিলপত্র যাচাই ও পরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি এই সময়ের ফিনিশ গুডস হিসেবে বেশ কিছু পণ্য আমদানি করেছে, যার মধ্যে রয়েছেÑটেবিল ল্যাম্প, ছাতা, ব্যাকপ্যাক, কুশন কভার, ব্যাক কুশন, ওয়াল হ্যাঙ্গিং অরগানাইজার, বেডশিট, কিচেন ছুরি সেট, ওভেন গ্লাভস ইত্যাদি। এসব পণ্যকে প্রতিষ্ঠানটি প্রমোশনাল আইটেম দেখিয়ে অবৈধভাবে রেয়াত নিচ্ছে। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ অনুযায়ী পণ্যগুলো উপকরণের সংজ্ঞাভুক্ত নয়। কিন্তু একমি এসব প্রমোশনাল আইটেমকে উপকরণ দেখিয়ে রেয়াত নিয়েছে।

প্রাথমিক হিসাবে দেখা গেছে, এসব প্রমোশনাল আইটেমে প্রতিষ্ঠানটি আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট পরিশোধ করেছে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা, যা প্রতিষ্ঠান রেয়াত নিয়েছে। আবার পণ্যগুলো প্রমোশনাল আইটেম হিসেবে অন্যের কাছে সরবরাহকালে ব্যবসায়ী পর্যায়ে পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। সেই ভ্যাট পরিশোধ করেনি একমি। উল্টো আমদানি পর্যায়ে পরিশোধিত প্রায় ৫১ লাখ টাকার আগাম কর সমন্বয় করেছে। ভ্যাট ও আগাম করসহ মোট ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ টাকা। মূসক আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের এই রেয়াত গ্রহণ ও হ্রাসকারী সমন্বয় করা আইনানুগ ও বিধিসম্মত হয়নি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে পরে প্রতিষ্ঠানের শুনানি শেষে টাকার অংশ কিছু কমেছে। পরে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে এলটিইউ। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠান টাকা পরিশোধ না করে আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছে বলে এলটিইউ সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র আরও জানায়, একমির প্রতিনিধি শুনানিতে অংশগ্রহণ করে লিখিত বক্তব্য দেন, যাতে পণ্যগুলো প্রমোশনাল আইটেম হিসেবে বাজারজাতকরণে ব্যবহার করা হয়েছে বলে স্বীকার করা হয়েছে। তবে প্রমোশনাল আইটেম আমদানি-পরবর্তী অন্য কারও কাছে সরবরাহ ব্যতিরেকে কোম্পানি নিজস্ব প্রয়োজনে বাজারজাতকরণে ব্যবহার করেছে। সেজন্য স্থানীয় কোনো ব্যবসা সংগঠিত না হওয়ায় পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য নয় বলে দাবি করা হয়। অপরদিকে শুনানিতে এলটিইউর পক্ষ থেকে ‘ঔষধ নীতি, ২০১৬’-এর অনুচ্ছেদ (বি) বিজ্ঞাপন বিষয়ে নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন ছাড়া ঔষধের কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। এবং অনুমোদনহীন বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই লক্ষ্যে যে কোনো অনৈতিক বিপণন কিংবা বহুস্তর বিপণন রোধ করা হবে।’ এ বিষয়ে শুনানিতে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ঔষধ প্রশাসনের কোনো অনুমোদন উপস্থাপন করতে পারেননি। একমির মতো কোম্পানি অবৈধ রেয়াত গ্রহণ ও ভ্যাট পরিশোধ না করে উল্টো আগাম কর সমন্বয় করায় হতবাক ভ্যাট কর্মকর্তারা।

সূত্রমতে, ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি একমি ২০১৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে বর্তমানে ‘এ’ ক্যাটেগরিতে অবস্থান করছে। কোম্পানিটির ৫০০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনের বিপরীতে পরিশোধিত মূলধন ২১১ কোটি ৬০ লাখ ২০ হাজার টাকা। ডিএসই থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, কোম্পানিটির মোট ২১ কোটি ১৬ লাখ এক হাজার ৭০০টি শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা বা পরিচালকদের কাছে ৩৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে ৩০ দশমিক ০৭ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীর কাছে শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে বাকি ২৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। গতকাল কোম্পানিটির শেয়ারদর শূন্য দশমিক ৫৮ শতাংশ বা ৫০ পয়সা কমে প্রতিটি সর্বশেষ ৮৫ টাকা ১০ পয়সায় হাতবদল হয়, যার সমাপনী দর ছিল ৮৫ টাকা ৪০ পয়সা। আর গত এক বছরের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ারদর সর্বনিন্ম ৬৭ টাকা ২০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১১৭ টাকা ৭০ পয়সার মধ্যে ওঠানামা করে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০