মো. জিল্লুর রহমান: গত ৪০ বছরে চীনে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চীন এরই মধ্যে বিশ্বের মেগা কারখানা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। চীনের এই অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ‘অলৌকিক অর্থনীতি’ বলা হয়ে থাকে, যার মূল চালিকাশক্তি বিশাল এক অভিবাসী কর্মিবাহিনী। একসময় চীনের অধিক জনসংখ্যাকে সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হতো, আর সেই জনসংখ্যাই এখন চীনের জনসম্পদে পরিণত হয়েছে। এই শক্তি দেশটির গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে কাজ করতে যাওয়া লাখো মানুষের জনবল। বর্তমানে চীন পিপিপি বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির দিক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং নমিনাল জিডিপির দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। এছাড়া ১৪০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে চীন বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জনবহুল দেশ হওয়ার পাশাপাশি আয়তনের দিক থেকে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। বিশাল হিউম্যান রিসোর্স, লাখ লাখ হেক্টর জমি, রিসোর্সের যথাযথ ব্যবহার এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে চীন বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্যতম পরাশক্তি হয়ে উঠেছে।
২০২১ সাল কভিডজনিত মন্দা বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকোচন ঘটিয়েছে। এটাকে বিশ্বব্যাংক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে বৃহত্তম অর্থনৈতিক মন্দা হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যা ছোট-বড় নির্বিশেষে সব অর্থনীতির ওপর কমবেশি প্রভাব ফেলেছে। এতে দেশগুলোর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে শীর্ষ ১০ অর্থনীতিতে বেশ উত্থান-পতন দেখা গেছে। যেমন চার দশক পরে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির আসনটি হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় থেকে এক নম্বর অবস্থানে উঠে এসেছে চীন। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শীর্ষ দশের বাকি আট দেশও যেভাবে ২০২০ সাল পার করেছে, তা ২০২১ সালেও অব্যাহত ছিল। অর্থনৈতিক উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে চীন সামরিক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সেখানেই। এ কারণেই চীনের অর্থনৈতিক উত্থানকে ঠেকানোর জন্য চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ও শর্তারোপ করছে।
২০২০ সালে চীনের জিডিপির আকার ছিল ২৯ লাখ ৪৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির আকার ছিল ২২ লাখ ৩২ হাজার কোটি ডলার। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৩ লাখ ১৮ হাজার কোটি ডলার এবং চীনের জিডিপি ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি ডলার।
চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেভাবে ঘটেছে, তা দ্রুততা ও বিশালতার দিক দিয়ে এতটাই যুগান্তকারী যে, প্রায়ই একে ব্যাখ্যা করা হয় একটা অলৌকিক ঘটনা হিসেবে। বহু বছরের অর্থনৈতিক স্থবিরতা আর দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে সময় পার করার পর কমিউনিস্ট রাষ্ট্রটি ১৯৭০ সালের শেষ দিক থেকে অর্থনীতি উম্মুক্ত করতে ও সংস্কারের পথে হাঁটতে শুরু করে।
বর্তমানে সাংহাই বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোর একটি। কিন্তু যারা এই শহরের আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলো তৈরি করেছে এবং যাদের শ্রমে তৈরি নানা ধরনের পণ্যসামগ্রী এই শহরেরই বন্দর থেকে পাড়ি জমাচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে, তারা চীনের গ্রাম ছেড়ে শহরে কাজ করতে যাওয়া মানুষের ঢল। দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং প্রদেশের পার্ল নদীর বদ্বীপ এলাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর অন্যতম এবং এটি কারখানায় ঠাসা। এখানকার অসংখ্য কারখানায় তৈরি পোশাক ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী সেখান থেকে চালান হয়ে সারা বিশ্বের নানা দেশে যায়। কিন্তু সেখানকার লাখ লাখ কর্মী এসেছেন বিভিন্ন গ্রাম থেকে, যাদের বসতি হুকো ব্যবস্থায় নথিভুক্ত তাদের গ্রামে। তারাই চীনের ভাসমান কর্মশক্তিÑঅভ্যন্তরীণ অভিবাসী। ধারণা করা হয়, বর্তমানে চীনে ২৫ কোটির বেশি মানুষ কাজের জন্য নানা শহরে গিয়ে বসতি গড়েছে। তারা দেশটির মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ।
চার দশক আগে চীনের মানুষ ছিল হুকো পদ্ধতিতে বন্দি। এই হুকোর আওতায় মানুষের স্বাধীনভাবে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যাওয়ার অধিকার ছিল না। এই হুকো হলো মানুষকে এলাকার ভিত্তিতে নথিভুক্ত করার চীনের বহু প্রাচীন একটা পদ্ধতি। এতে পরিবারগুলোকে এলাকার ভিত্তিতে নথিবদ্ধ করা হতো এবং এই ব্যবস্থার অধীনে পরিবারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হতো। ১৯৫০ থেকে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষ পর্যন্ত চীনের ভেতরে মানুষের চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ ছিল। নিজ এলাকা থেকে বেরোনোর জন্য প্রত্যেককে অনুমতি নিতে হতো। নিজের শহর বা গ্রাম থেকে অন্য এলাকায় যেতে হলে ভ্রমণের জন্য বিশেষ অনুমতিপত্র লাগত। কিন্তু আশির দশক থেকে এই বিধিনিষেধ উঠে যেতে শুরু করে। ফলে দেশের ভেতরে যেখানে ভালো কাজের সুযোগ-সুবিধা আছে, সেখানে মানুষের স্বাধীনভাবে যাওয়ার পথ খুলে যায়। আর এ কারণেই চীনের ভেতরেই হঠাৎ করে শহরমুখী অভিবাসনের একটা ঢল শুরু হয়। তবে শহরে অভিবাসী কর্মীদের কাজ করার অনুমতি ছিল না, তখন গ্রামের পরিবারগুলোর ভরণপোষণ করা কঠিন ছিল। এরপর হঠাৎ অর্থনীতিতে একটা জোয়ার এলো, বিশেষ করে উপকূলবর্তী এলাকায়। গ্রামের মানুষদের জন্য এসব শহরের কারখানাগুলোয় গিয়ে কাজ করার বিরাট একটা সুযোগ তৈরি হলো। তাদের জন্য ভালো আয়-উপার্জনের পথ খুলে গেল। তারা গ্রামে উপার্জনের অর্থ পাঠাতে শুরু করল, তাদের পুরো পরিবারের জীবনের মান উন্নত হতে শুরু করল।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সোভিয়েত কমিউনিস্ট পদ্ধতিটি ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ সালে প্রথমবারের মতো চীনের অর্থনীতিতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ কারণে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত দেশটির শিল্পোৎপাদন গড়ে ১৯ শতাংশ হারে এবং জাতীয় আয় বছরে ৯ শতাংশ হারে বাড়তে থাকে। ১৯৫৬ সালের মধ্যে দেশটির ৬৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ শিল্প প্রাতিষ্ঠানিক এন্টারপ্রাইজ রাষ্ট্রমালিকানাধীন এবং ৩২ দশমিক পাঁচ শতাংশ পাবলিক প্রাইভেট মালিকানাধীন হয়ে ওঠে।
১৯৬১ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত কৃষি খাতে উৎপাদন প্রতি বছর গড়ে ৯ দশমিক ছয় শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি শিল্প উৎপাদনও গড়ে ১০ দশমিক ছয় শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দেশটির অর্থনীতি বেশ দ্রুত ঠিক হয়ে যায়। শিল্প উৎপাদনও ১৯৭৭ সালে ১৪ শতাংশ এবং ১৯৭৮ সালে ১৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দেশটির ইকোনমিক আউটপুটের একটি বড় অংশ সরাসরি সরকার-নিয়ন্ত্রিত হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদনের উদ্দেশ্য ঠিক করা, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ করা এবং অর্থনীতির একটি বড় অংশের সম্পদ বণ্টন করাও তখন পর্যন্ত সরকার নিয়ন্ত্রণ করত।
১৯৭৮ সালের ডেং শিয়াওপিংয়ের নেতৃত্বে চীনের অর্থনৈতিক সিস্টেমের সংস্কার শুরু হয়। তিনি চীনের কমিউনিজম সিস্টেম একেবারে বাতিল না করে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে এনে বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন। প্রথমে আবাদি জমি আংশিকভাবে বেসরকারিকরণের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই পদ্ধতিতে জমির মালিকানার পরিবর্তে জমি ব্যবহারের অধিকার দেয়া হয়। মানুষজন তাদের এই জমি ব্যবহারের অনুমতিতে কেনাবেচাও করতে পারত।
১৯৮৭ সাল নাগাদ চীন আধুনিক ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্য শুরু করার জন্য চীন সরকার বৈদেশিক ফার্মগুলোর সঙ্গে সরাসরি আলাপ-আলোচনা করার পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোর্ট আরও সহজ করতে ট্রেডিং ও ক্রেডিট ম্যানেজমেন্ট পলিসি সংশোধন করে। এর পাশাপাশি বেশ কিছু সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল ও শহরকে ফ্রি মার্কেট হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ওপেন সিটি এবং ডেভেলপমেন্ট জোন হিসেবে বিভক্ত করা হয় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগে আকর্ষণ করার জন্য টেক্স ও ট্রেড সুবিধা দেয়া হয়।
১৯৯৭ সালে ডেং শিয়াওপিংয়ের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী জিয়ান জেমিং এবং জুডংজি এই সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যান। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বেসরকারিকরণ চলতে থাকে। চলতি শতাব্দীর প্রথম দশকের প্রথমার্ধে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজের পরিমাণ ৪৮ শতাংশ কমে যায়। কিন্তু বিদ্যুৎ, পেট্রোলিয়াম, টেলিকমিউনিকেশন ও এভিয়েশনে সরকার তখনও মনোপলি ধরে রেখেছিল।
২০০১ সালে চীন ব্যবসায়ের জন্য ট্যারিফ বাণিজ্য বাধা ও প্রবিধান কমিয়ে দেয় এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৯০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত চীনের অর্থনীতি গড়ে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, যা সেসময়কার অন্য যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির তুলনায় বেশি। ২০০৫ সালে চীনের প্রাইভেট সেক্টর জিডিপি অবদানে ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। ২০০৬ সালে চীনের সর্বমোট বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় এক দশমিক ৭৬ ট্রিলিয়ন ডলারে, যা দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পর তৃতীয় সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক জাতি করে তোলে। এর পর থেকেই চীন মূলত অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্রমান্বয়ে উন্নতি করে আসছিল। শ্রমিকের মজুরি কম হওয়ার ফলে বড় বড় করপোরেশনের জন্য চীন একটি আকর্ষণীয় উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
হাউমাচ ডট নেট নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ১৯৮০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪০ বছরের ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিশ্বের শীর্ষ ১০ জিডিপি নিয়ে ২০২১ সালের জন্য পূর্বাভাস দিয়েছে। ১৯৮০ সালের প্রথম তালিকায় শীর্ষস্থান পায় যুক্তরাষ্ট্র। তখন দেশটির জিডিপির আকার ছিল দুই দশমিক ৮৬ ট্রিলিয়ন ডলার, কিন্তু চীন তখন শীর্ষ দশেই ছিল না। অবশ্য পরের দশকে অর্থাৎ ১৯৯০ সালে চীন শীর্ষ দশে উঠে আসে। গত কয়েক দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এশিয়ার অনেকগুলো উন্নয়নশীল দেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। এর মধ্যে চীন ছাড়া ভারত ও ইন্দোনেশিয়া শীর্ষ দশে রয়েছে। এশিয়ার দেশ জাপান ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। ২০১০ সাল থেকে এটি চতুর্থ অবস্থানে চলে যায়। অপরদিকে ২০২০ সালে ইন্দোনেশিয়া প্রথমবারের মতো সপ্তম স্থানে উঠে আসে এবং ২০২১ সালেও এখানেই থাকবে। নতুন বছরে ভারত, জাপান ও ইন্দোনেশিয়ার জিডিপির আকার হবে যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৫৬ ট্রিলিয়ন, ছয় দশমিক শূন্য চার ট্রিলিয়ন ডলার ও চার দশমিক তিন ট্রিলিয়ন ডলার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতিতে ফ্রান্স দুর্বল হয়ে যায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটেনের কাছে এবং ব্রিটেন বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি হয়ে ওঠে এবং সুয়েজ খাল সংকটকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের ভুল পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক নেতৃত্বে নিয়ে আসে। করোনা সংকটের ভূরাজনৈতিক প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে এটি এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে বড় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং করোনা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র যে অপরিণামদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে, তারই সূত্র ধরে অনেকে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে চীনের উত্থানের কথা ভাবছে।
এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান স্নায়ুযুদ্ধ বিশ্বের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই চীনের সঙ্গে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কেবল বাণিজ্য নয়, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ইস্যু নিয়ে উত্তপ্ত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক। জিনজিয়ান প্রদেশে মুসলমানদের দমনপীড়নের জন্য দায়ী চীনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এছাড়া চীনা কোম্পানিগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু করেছে। বিশেষত চীনা টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়েকে। ওয়াশিংটনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর বেইজিংয়ের গুপ্তচরবৃত্তিতে সাহায্য করেছে হুয়াওয়ে। চীন ও হুয়াওয়ে উভয়ই এ অভিযোগ অস্বীকার করে। যুক্তরাষ্ট্র ফাইভ-জি নিয়ে তার অবস্থান হারায়, যা নতুন ডিজিটাল অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যদিকে হুয়াওয়ে বিশ্ববাজারে আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করেই বিশ্বব্যাপী সমালোচনা ছড়িয়েছিল যে হুয়াওয়ে হুমকিস্বরূপ। মিত্রদেশগুলোর সঙ্গেও তারা হুয়াওয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করার চেষ্টা চালায়। আমরা চীনের যে উন্নয়নের চিত্র দেখি, তা ২০০০ সাল পর্যন্ত স্বাভাবিক গতিতে এসেছে ১৯৭৮ সালে চীন বিশ্ব অর্থনীতির জন্য নিজেকে উম্মুক্ত করে দেয়ার পর। এই সময়টাতে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ছয়-সাত শতাংশ। ২০০০ সালের পরে গিয়ে এই প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। চীন যে এই অস্বাভাবিক গতিতে এগোনোর সুযোগ পেল এর দায়ও বর্তায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর।
দারিদ্র্য দূরীকরণ থেকে শুরু করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেখানোর মতো কোনো সাফল্য যদি থেকে থাকে, তবে তা চীনের হাতেই রয়েছে। কারণ দারিদ্র্য দূরীকরণে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বাইরে ভিন্ন পদ্ধতিতে চীনই বিশ্বের কাছে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে গণতান্ত্রিক হিসাবনিকাশ নস্যাৎ করে চীনই দেখিয়েছে এই পদ্ধতি ছাড়াও ভিন্ন পদ্ধতিতে চরম প্রান্তিক দারিদ্র্যের হাত থেকে কীভাবে মুক্তি পেতে হয়। তাছাড়া চীন যখন কোনো দেশকে ঋণ দেয়, তখন তারা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত পরিবর্তনের শর্ত আরোপ করে না। চীন একটা আদর্শ ও মান সামনে নিয়ে আসে, যা ঋণ নেয়া দেশ অনুসরণ করতেও পারে আবার নাও করতে পারে। এক্ষেত্রে কিছু শিখতে চাইলে চীনের কাছ থেকে শেখার সুযোগ রয়েছে।
বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন অত্যন্ত প্রভাবশালী, বর্তমান অর্থনীতির বাজার অনেকটাই চীন দখল করে নিয়েছে এবং বিশ্ব অর্থনীতির বাজারে অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে চীন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে চীন শিল্পনির্ভর অর্থনীতিমুখী হয়ে পড়েছে সেই মাও সে তুংয়ের শাসনামল থেকেই। তারও অনেক আগে চীনের রেশম কাপড়, তেলচিত্র ও রঙের কদর বিশ্বজুড়ে ছিল। হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণকাহিনিতে যে চীনের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেই মতে চীনের মনোহারী দ্রব্যের কদর বিশ্বজুড়ে ছিল। বিংশ শতাব্দীর পরবর্তিত প্রেক্ষাপটে চীন এরপর ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যায়। সেই সিল্ক থেকে শুরু করে বর্তমান আইফোন সব চাইনিজ পণ্য তখন থেকে এখন পর্যন্ত গ্রাহকদের কাছে চাহিদার শীর্ষে।
কিছুদিন আগেও চীনের অর্থনৈতিক উত্থানকে কোনো উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখা হতো না। মনে করা হতো, তাদের বিকাশমান অর্থনীতি ক্রমেই উদার হতে থাকা রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা সে সময় বলতেন, ‘চীন একটি দায়িত্বশীল বৈশ্বিক অংশীদার হয়ে উঠছে।’ কিন্তু সেদিন আর নেই। চীনকে এখন দেখা হচ্ছে এক হুমকি হিসেবে। অনেকেই ভয় পাচ্ছে যে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে শেষ পর্যন্ত একটা যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। তা যদি হয়, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া হবে বিশ্বব্যাপী।
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে চীন পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে রাজনৈতিকভাবে, সামরিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে ছিল। প্রাচীন গ্রিসে যেমন এথেন্স চ্যালেঞ্জ করেছিল স্পার্টাকে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানি যেমন চ্যালেঞ্জ করেছিল ব্রিটেনকে, ঠিক তেমনি এ যুগে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করছে চীনের উত্থান।
ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক
rbbbp@gmail.com