ইসমাইল আলী: ভারতের আদানি গ্রুপের গড্ডা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। এজন্য চুক্তি হয় ২০১৭ সালে। একইভাবে বাংলাদেশের এস আলমের কয়লাভিত্তিক এসএস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে সরকার। এ চুক্তি সই হয়েছিল ২০১৬ সালে। আগামী ডিসেম্বরে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। তবে এতদিন পর চুক্তিতে ভুল শনাক্ত করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
ভুল চুক্তির ফলে দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাসে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার আশঙ্কা করছে পিডিবি। এজন্য দ্রুত বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত মতামত বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠিয়েছে পিডিবি।
সূত্রমতে, বর্তমানে দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে দুটি। একটি বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। পিডিবির অধীন এ কেন্দ্রটি বড়পুকুরিয়ার কয়লাখনির কয়লা দিয়েই পরিচালিত হয়। এজন্য কয়লার দাম দিতে হয় প্রতি টন ১৩০ ডলার, যা আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে অনেক। তবে খনি থেকে নিয়মিত কয়লা সরবরাহ করতে না পারায় প্রায়ই এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হয়।
কয়লাচালিত অপর বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রায় অবস্থিত বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ায় কোম্পানি লিমিটেড। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যৌথ মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন লিমিটেড (সিএমসি)। দুই বছর আগে উৎপাদন এলেও গত জুন থেকে পুরোদমে চলছে কেন্দ্রটি।
এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে কয়লা সরবরাহের জন্য চলতি বছর এশিয়ান ট্রেড কমোডিটিস পিটিই লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, নিউক্যাসেল কোল ইনডেক্স অনুযায়ী কয়লার দাম নির্ধারিত হবে। এক্ষেত্রে মান অনুযায়ী কয়লার দাম পরিশোধ করতে হয়। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে মানের কয়লা কেনা হচ্ছে, তাতে প্রতি টনে ৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। চুক্তিমতে, প্রতি টন কয়লার দাম ১১০ ডলারের বেশি হলে বাড়তি দামের ৫৫ শতাংশ পরিশোধ করতে হয় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়লার হিটরেট (তাপন ক্ষমতা) অনুযায়ী পাঁচ হাজার ৫০০ এমএমএস কয়লা ব্যবহার করা হচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে। আর বর্তমানে নিউক্যাসেল ইনডেক্সে কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারদর ৪৩৪ ডলার। এতে ১১০ ডলারের ওপর বাড়তি দরের জন্য ৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্টের ভিত্তিতে প্রতি টন কয়লার দাম পড়ছে ২৩৭ ডলার। এতে কেন্দ্রটিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়ছে প্রায় সাড়ে ১২ টাকা, যা ফার্নেস অয়েলের সমান।
অন্যদিকে আদানি ও এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সম্পাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে (পিপিএ) কয়লার দামের ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর ধরা হয়নি। বরং আন্তর্জাতিক বাজারদরে কয়লার দাম নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। এতে ওই দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি টন কয়লার দাম পড়বে বর্তমান হারে ৪৩৪ ডলার। ফলে প্রতি টন কয়লা কেনায় বাড়তি দাম গুনতে হবে ১৯৭ ডলার। এতে কেন্দ্র দুটিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়বে প্রায় ২১ টাকা টাকা, যা ডিজেলচালিত কেন্দ্রের সমান।
পিডিবির এক হিসাবে দেখানো হয়েছে, ৭০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে (সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার ধরে) আদানির ও এস আলমের কয়লাচালিত কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে মাসে কয়লার বিল বাবদ পিডিবিকে অতিরিক্ত গুনতে হবে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এজন্য কোম্পানি দুটির সঙ্গে চুক্তি সংশোধনের সুপারিশ করেছেন পিডিবির সদস্য (উৎপাদন)। সম্প্রতি তিনি পিডিবির চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানিয়ে মতামত দিলে তা বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
যদিও এ বিষয়ে পিডিবির চেয়ারম্যান ও সদস্য (উৎপাদন) কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, আদানি ও এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার যে দাম ধরা হয়েছে তাতে মাসে বাড়তি গুনতে হবে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। বছরে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাবে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটিতে উৎপাদন ব্যয় পড়বে ডিজেলের সমান। তখন ডিজেলের মতো বিদ্যুৎ না কিনে বসিয়ে রেখে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ গোনা ছাড়া উপায় থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, বিষয়টি এতটাই ভয়াবহ যে, কাকে এজন্য দায়ী করা যায় তা খোঁজা হচ্ছে। এজন্য কোনো পক্ষই এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি নন। কারণ এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে যে কেউ বিপদে পড়তে পারেন। তবে পিডিবির বিশাল ক্ষতির বিষয়টি মাথায় নিয়ে দ্রুত চুক্তি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগ কাজ করছে। আশা করা যায়, বিষয়টি সমাধান করা যাবে।
উল্লেখ্য, গত আগস্ট পর্যন্ত ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মাণাধীন আদানির গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি ছিল ৯০ শতাংশ। আগামী ১৬ ডিসেম্বর এ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার জন্য সম্প্রতি ভারত সফরের সময় অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেন্দ্রটির জন্য কয়লা কিনতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর দরপত্র আহ্বান করেছে আদানি পাওয়ার লিমিটেড।
এদিকে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন এসএস পাওয়ারের অগ্রগতি গত আগস্ট পর্যন্ত ছিল ৯৫ শতাংশ। এ কেন্দ্রটিরও আগামী ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে। এ কেন্দ্রের জন্য ইন্দোনেশিয়ার পিটি বায়ান রিসোর্স লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে এসএস পাওয়ার লিমিটেড।