মফিজ জোয়ার্দ্দার, চুয়াডাঙ্গা: সেলিমা খাতুনের বড় ছেলে খোকন জোয়ার্দ্দার বলেন, ১৯২৫ সালে শেষবার বাদুড়তলায় ঈদের জামাত হয়েছিল। নানা ও মায়ের মুখে বাদুড়ের গল্প শুনেছি। তারা বলতেন, অনেক বছর ধরে বাগানে বাদুড় রয়েছে। তাই গাছগুলো কখনও কাটার চিন্তা করা হয়নি। নানা ১৯৫১ সালে বাগানে একটি মিল তৈরি করেন। ১৯৬০ সালে বেশ কয়েক দিন তাপদাহ পড়েছিল। তাপদাহের কারণে বাদুড় মারা যাচ্ছিল। নানা ভারত থেকে একটি পানি ছিটানোর মেশিন নিয়ে আসেন। সেই মেশিন দিয়ে বেশ কয়েক দিন পানি ছিটানো হলে বাদুড়গুলো প্রাণে রক্ষা পায়। ৯ বিঘা জমির ওপর ছিল বাদুড়তলার বাগান। ১৯৯২ সালে আমার ছোট খালা কয়েকটি তেঁতুল গাছ কেটে ফেলেন। আর দুটি গাছ মারা যায়। ছোট ভাইয়ের জমিতে চারটি তেঁতুল গাছ রয়েছে। সেখানে বাদুড়গুলো নিরাপদে রয়েছে। গাছগুলোর বয়স প্রায় ১৫০ বছর। তেঁতুল গাছ যত দিন বেঁচে থাকবে, বাদুড়গুলো ততদিন থাকবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বাদুড়দের এ নিজস্ব সাম্রাজ্য চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার পাশে ওয়াপদাপাড়ায়। অসংখ্য বাদুড় ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিঁচিঁ শব্দে মুখর রাখে বাদুড়তলা। দিনে বাদুড়গুলো ৪টি তেঁতুল গাছের ডালে ঝুলে থাকে, আর এ-ডাল থেকে ও-ডালে ছুটে বেড়ায়। সন্ধ্যা হলেই খাবারের জন্য বেরিয়ে পড়ে স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো। উদ্ভিদের পরাগায়নের জন্য কাজ করে বাদুড়গুলো।
দূর-দূরন্ত থেকে সাধারণ মানুষ ছুটে আসে বাদুড় দেখতে। বাদুড়ের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে কোটি টাকার সম্পত্তি। উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা বলেন, এ প্রজাতির প্রাণীগুলো সংরক্ষণ করতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
ইবাদত আলী জোয়ার্দ্দার নামের এক ব্যক্তি প্রায় ২০০ বছর আগে বাদুড়তলায় বসবাস করতেন পরিবার নিয়ে। সে সময় জোয়ার্দ্দার ও মল্লিক বংশের লোকজনের বসবাস ছিল এখানে। ইবাদত আলী জোয়ার্দ্দারের সব সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন তার বড় ছেলে ইউসুফ আলী জোয়ার্দ্দার। ইউসুফ আলী জোয়ার্দ্দারের ছিল দুই মেয়ে সেলিমা খাতুন ও হাসিনা খাতুন। বাবা মারা যাওয়ার পর তার দুই মেয়ে বাদুড়তলার সম্পত্তির ভাগ পায় সাড়ে ৪ বিঘা করে জমি। সেলিমা খাতুন ৬ ছেলে ও ৩ সন্তান নিয়ে স্থায়ীভাবে চুয়াডাঙ্গায় বসবাস করেন। আর হাসিনা খাতুন পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকায়। হাসিনা খাতুন তার সম্পত্তিগুলো বোনের ছেলে ও স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে দেন।
সেলিমা খাতুনের ৬ ছেলে ও ৩ মেয়ে পান চুয়াডাঙ্গা ওয়াপদাপাড়ার বাদুড়তলার জমি। তারা বাদুড়গুলো সংরক্ষণের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন।
বাদুড়ের বসবাসের কারণে এ এলাকার নামকরণ হয়েছে বাদুড়তলা নামে। বাদুড়ের নামে বাদুড় মার্কা আটা, ময়দা, সুজি ও ভুসির নামকরণ করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গাসহ পার্শবর্তী জেলায় বাদুড় মার্কা পণ্যগুলোর চাহিদা রয়েছে।
জমির মালিকের আরেক ভাই জাহিদ মিয়া জানান, প্রাণীগুলো নিজের সন্তানের মতো। তাদের ওপর দরদ ও ভালোবাসা জšে§ছে। নিরীহ প্রাণীগুলো দ্বারা কোনো ক্ষতি হয়নি। এদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য জমি ছেড়ে দিয়েছি। আমার সন্তানদের বলেছি, বাদুড়ের পুরোনো আবাসস্থল নষ্ট না করার জন্য।
মেহেরপুরের বাজারপাড়ার বাসিন্দা রাশেদুজ্জামান জানান, অনেকের মুখে গল্প শুনেছি বাদুড়ের। তাই দেখতে ছুটে এলাম বাদুড়তলায়। বাদুড়ের ডাক শুনে আমি মুগ্ধ। এত বাদুড় একসঙ্গে কখনও দেখিনি আগে।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বিশিষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তৌহিদ হোসেন বলেন, ছোটবেলা থেকে গাছে বাদুড় দেখছি। সকালে ঘুম ভাঙার পর বাদুুড়ের চিঁচিঁ শব্দ শুনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান জানান, পরিবেশ সংরক্ষণে বাদুড়ের ভূমিকা রয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এএইচএম শামিমুজ্জামান বলেন, বাদুড় থেকে নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়েছে এমন তথ্য জেলায় নেই। চারটি তেঁতুল গাছে প্রায় ৩ হাজার বাদুড় নিরাপদে রয়েছে।