প্রতিনিধি, চুয়াডাঙ্গা: চুয়াডাঙ্গার দর্শনার দারুস সুন্নাত সিদ্দিকীয়া সিনিয়র ফাজেল (ডিগ্রী) মাদ্রাসার বহুল আলোচিত ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক আরিফুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনিয়ম করে কযেক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওযার অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে শিবির কর্মী হিসেবে চাকরী শুরু, এরপর আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন অনিয়ম ও সর্বশেষে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিয়ে আবারো তিনি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিজয়ের দিন এ শিক্ষক লোহারপাইপ নিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগরের বাড়ীসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙ্গে নিজেকে বিএনপির নেতা বলে পরিচয় দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরের দিন দর্শনা মাদ্রাসায় আবারো বিএনপি কোটায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার আশায় অধ্যক্ষের কক্ষে তালা লাগিয়ে ইউএনও বরাবর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকের অপসারণ চেয়েছেন তিনি।
সূত্র জানিয়েছে, কোটি টাকার ঘাপলা ধামাচাপা দিতেই তার এই অপতৎপরতা। সদর থানার অর্ন্তগত আকন্দবাড়ীয়া গ্রামের মরহুম জালালউদ্দীন মাস্টারের ছেলে জোট সরকারের আমলে তৎকালীন অধ্যক্ষের ঘনিষ্ট আত্মীয়ের পরিচয়ে ১৭ প্রার্থীর মধ্যে একমাত্র পাশকোর্সের ডিগ্রিধারী হয়েও শিবির কোটায় প্রভাষকের চাকুরী বাগিয়ে নেন। এরপর অধ্যক্ষের পদ শূন্য হলে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নীতিমালা ভেঙ্গে ভাইস প্রিন্সিপাল ও সিনিয়রদের টপকে দীর্ঘ সময় তৎকালীন সভাপতি সংসদ সদস্যের উপদেষ্টা খ্যাত মানিচেঞ্জার ব্যবসায়ী গোলাম ফারুক আরিফের যোগসাজসে একাধিকবার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের পদ দখলে রাখেন। এ সময় অধ্যক্ষ পদে পত্রিকায় সার্কুলার দিয়ে প্রার্থী পাওয়া সত্বেও এ পদলোভীর শিক্ষকের কারনে নিয়োগ প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। মাদ্রাসা অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় পরিণত করেন তিনি।। অভিযোগ রয়েছে, তার কারনে এতদঞ্চলের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসার দ্বীনি পরিবেশ ও লেখাপড়ার মান নষ্ট হয়।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সাধারণ শিক্ষক হিসেবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হয়ে নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন পদের লোভে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেননি। আরিফুজ্জামান দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে ১৩টি পদে জন প্রতি ৫ লাখ থেকে ১২ লাখ করে প্রায় ৮০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেন। এছাড়া অবৈধ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দামুড়হুদা উপজেলার কুড়ুলগাছী গ্রামের আবু জার গিফারী নামের একজনের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে চাকরি দিতে ব্যার্থ হন। ওই প্রার্থীর কাছ থেকে নেয়া ঘুষের টাকা তিনি ফেরত দেননি। রেজুলেশন বা কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়াই মাদ্রাসার ক্লাসরুম গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে প্রায় ৮১ লাখ ৮ হাজার টাকা অগ্রিম গ্রহণ করেন। ভাড়াটিয়াদের নিকট থেকে অগ্রিম নেয়া টাকার কোন রশিদ প্রদান করেননি। আবার সেই টাকা মাদ্রাসার ব্যাংক একাউন্টেও জমা দেননি। আরিকুজাজামান মাদ্রাসায় ঠিকমত না এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেন। তিনি প্রতিষ্ঠানে বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টার দিকে আসেন। বিগত কয়েক বছর ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নেয়ার কোন রেকর্ড নেই। তার প্রভাব ও ধার করা টাকা নেওয়া আছে বলে শিক্ষকরা প্রতিবাদ করে না। বরং প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আয় ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন না করে বানোয়াট বিল ভাউচার দিয়ে সমন্বয় করে। এর মধ্যে কিছু তার পক্ষের শিক্ষককে ওই টাকা অলিখিত ভাবে প্রদান করে ও বিভিন্ন সুবিধা দেয় বলে সে সব শিক্ষক মুখ খোলেনা বরং তাকে সমর্থন দেয়।
প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রিন্সিপাল তার অসময়ে মাদ্রাসায় আসার ব্যাপারে প্রতিবাদ করায় তাকে মারতে উদ্যত হন ও বিভিন্ন সময়ে ভাইস প্রিন্সিপালের কাছ থেকে সুবিধা নিতে না পারলে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেন। অন্য শিক্ষকদের উপর চড়াও হন। এছাড়া তার অসময়ে আসার জন্য প্রতিবাদ করায় আরিফুজ্জামান হাজিরা খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলে। এ কারনে তাকে শোকজ করা হয়। এছাড়া গত ৬ আগস্ট বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কক্ষে জোরপূর্বক তালা দেয় এবং কিছু প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস ছিঁড়ে ফেলে। তার বিরুদ্ধে ভারতীয় পণ্য চোরাচালানে জড়িত থাকা এবং তার চোরাচালানী বন্ধুদের মাদ্রাসায় এনে সময় কাটানো ও কেরামবোর্ড খেলার অভিযোগ রয়েছে। যা নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। গত ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ দর্শনা পৌরসভা উপ-নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ গ্রহণ করার জন্য ব্যাপক প্রচারণা ও গণসংযোগ চালান তিনি। অভিযোগ রয়েছে, তিনি মাদ্রাসা থেকে আয় করা টাকা দিয়ে নির্বাচনে ব্যয় করেছেন।
২০২০, ২০২২ ও ২০২৩ সালের ফাযিল পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট হতে উপবৃত্তি প্রদানের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় এবং ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে ছাত্রছাত্রী থেকে প্রসেস ফি বাবদ গড়ে ৫০০ টাকা করে অফিস সহকারী বজলুর রশীদের মাধ্যমে তিনি গ্রহণ করেন। কিন্তু আরিফুজ্জামানের অদক্ষতার কারনে রেজুলেশন ও যাচাই বাছাই কমিটি না করায় এবং সঠিকভাবে প্রসেস করতে না পারায় কোন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি ক্যারামবোর্ড খেলার প্রচলন করায় কতিপয় শিক্ষক ক্লাশ না নিয়ে সারাক্ষণ এ খেলায় ব্যস্ত থাকে। যে কারনে মাদ্রাসাটিতে সারা বছরের কখনো পূর্ণ ক্লাশ হয়না। দুই মেয়াদে ৪ বছর ৮ মাস ভারপ্রাপ্ত থাকাকালীন সময়ের আয়ও ব্যয়ের কোন হিসাব তিনি দাখিল করেননি। বরং অডিট এড়াতে ভাইস প্রিন্সিপালকে সরানোর জন্য উপজেলা ইউএনও বরাবর আবেদন করেন এবং তাকে দায়িত্ব দেয়ার জন্য আবদার করেন। সংগত কারনেই সচেতন মহল মাদ্রাসাটিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে তার সময়ের সমূদয় আয় ও ব্যয়ের হিসাব, নিয়োগ বাণিজ্য, মাদ্রাসার ক্লাশ, ভাড়া প্রদানে অনিয়মসহ যাবতীয় বিষায়াদি তদন্তের জোর দাবী জানিয়েছেন।
গত মঙ্গলবার দামুড়হুদা উপজেলা শিক্ষা অফিসার দর্শনা মাদ্রাসা তদন্তে এসে অবিভাবক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক প্রতিনিধি,সমাজ সেবক, সাংবাদিকসহ সুধী সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তিনি জানান, যত অভিযোগ শিক্ষক আরিফুজ্জামানের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল শফিউদ্দিন জানান,দায়িত্বভার গ্রহণের সময় কোন আয় ব্যয়ের হিসাব পায়নি তিনি পাননি। দোকান ঘর বরাদ্দের অগ্রীমসহ আদায়করা টাকা ব্যাংকে জমা হয়নি। সেই টাকার পরিমান প্রায় ৮২ লাখ। এ ব্যাপারে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে আরো কিছু বেরিয়ে আসবে। তদন্ত কমিটি গঠন করার পর থেকে ওই শিক্ষক নানাবিধ অভিযোগ এনে দামুড়হুদা ইউএনওর কাছে তাকে অপসারণের জন্য লিখিত দিয়েছে। তদন্ত শেষে শিক্ষা অফিসার বিস্তারিত জানাবেন।
পূর্বের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল আরিফুজ্জামান জানান, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সঠিক নয়। গভর্নিং বডির মতামতের ভিত্তিতে নিয়োগ হয়েছে। দোকান ঘর ভাড়া দেয়ার বিষয়ে সাবেক গভর্নিং বডি, শিক্ষক প্রতিনিধির মতামতের ভিত্তিতে হয়েছে একক কোনো সিদ্ধান্তে কোন কিছু করা হয়নি। আয় ব্যয়ের হিসাব দামুড়হুদা ইউএনওর কাছে জমা আছে। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালকে হিসাব দামুড়হুদা ইউএনও অফিস থেকে বুঝে নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি এখনো পর্যন্ত হিসাব বুঝে নেননি।