চুয়াডাঙ্গার প্রথম গেরিলা কমান্ডার হয়েও খেতাব পাননি হাফিজুর রহমান

মফিজ জোয়ার্দ্দার, চুয়াডাঙ্গা: চুয়াডাঙ্গার প্রথম গেরিলা কমান্ডার হয়েও খেতাব পাননি বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান জোয়ার্দার। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ৮ নং সেক্টর অধীন বৃহত্তর কুষ্টিয়া এলাকায় প্রথম গেরিলা কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রীয় কোন খেতাব পাননি এই বীর যোদ্ধা।

হাফিজুর রহমানের বাড়ী চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার বটিয়াপাড়া গ্রামে । বাবার নাম আজিবর রহমান জোয়ার্দার ও মাতার নাম আবেদা খাতুন । ৬ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ । তার বাবা আজিবর রহমান জোয়ার্দার ছিলেন চট্রগ্রাম রেলওয়ের একজন উর্দ্বতন কর্মকর্তা । বাবার চাকুরির সুবাধে লেখাপড়ার প্রাথমিক স্তর কাটে চট্রগামের রেল কলোনিতে । ১৯৬৫ সালে আজিবর রহমানের চাকুরী থেকে অবসরের সুবাধে আবার চুয়াডাঙ্গায় চলে আসেন ও ভিজে স্কুলে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি হন হাফিজুর। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাশ করে বড় ভাইয়ের চাকুরির সুবাধে আবার তিনি চট্টগ্রামে চলে যান এবং রাঙ্গুনিয়া কলেজে ইন্টার মিডিয়েটে  ভর্তি হন। তার বড় ভাই চন্দ্রঘোনা কাগজ কলের একজন বড় কর্মকর্তা ছিলেন। সেখানে লেখাপড়াকালীন সময়ে তিনি ছাত্রলীগের সাথে জড়িয়ে পড়েন । আইকম পাশ করে আবার চুয়াডাঙ্গা এসে ১৯৭০ সালে বিকমে চুয়াডাঙ্গা কলেজে ভর্তি হন । মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা হওয়া নিয়ে নিজের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেয়ার বিজের কাছে সে সময়ের দিনগুলোর কথা বলেছেন হাফিজুর রহমান।

শেয়ার বিজকে হাফিজুর বলেন, ১৯৭০ সালের  সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে এবং তৎকালীন ইয়াহিয়া সরকার অওয়ামীলীগকে সরকার গঠন করতে না দিলে আন্দোলন শুরু হয় । তখনও চুয়াডাঙ্গাতে মিছিল -মিটিং  শুরু হয়নি । এ সময়ে হাফিজুর  চুয়াডাঙ্গা- আলমডাঙ্গার নীলমিগঞ্জ,বটিয়াপাড়া ও বোয়ালমারীর কিছু বন্ধুদের সাথে নিয়ে মিছিল করার জন্য তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমান চুয়াডাঙ্গা -১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান জোয়ার্দার ছেলুনের সাথে দেখা করেন। ছেলুন তৎকালীন আওয়ামীলীগের চুয়াডাঙ্গা সভাপতি ডা: আশাবুল হক হেবার সাথে কথা বলতে বলেন । কথা বলার পর, তিনি আমাদের পরামর্শ দেন এখন মার্শাল ল চলছে যখন তখন গ্রেপ্তার হতে পার । যা করবে সাবধানে করবে। তারপর কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রায় ছোট ছোট মিছিল করতাম। এটা পরে বড় মিছিলে রুপ নেয় । গোয়েন্দা পুলিশের নজরে পড়লে ১৯৭০ সালের ২৫ আগষ্ট চুয়াডাঙ্গা রেল ষ্টেশনের পাশ থেকে পুলিশ আমাকে আটক করে। তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা সদর থানার কুখ্যাত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান  আমাকে আটক করে ও মার্শাল ল উপধারায় আমাকে কেস সাজিয়ে চালান দেয়। ঐ সময় ৩ মাস কুষ্টিয়া জেলে আটক থাকি।

তিনি বলেন ,২৬ মার্চ ঢাকায় ক্রাকডাউন হওয়াতে আন্দোলন বেগবান করার জন্য ৭১ সালের ৩১ মার্চ  চুয়াডাঙ্গায় দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর অফিস স্থাপন করা হয় যার প্রধান ছিলেন ডা:আশাবুল হক হেবা। এখান থেকে এই এলাকার যুদ্ধ পরিচালনা হতো। এপ্রিলের প্রথম থেকেই চুয়াডাঙ্গার উপর শেল, নামাপ বোমা ও মেশিন গানের গুলি বর্ষিত করতে থাকে পাকিস্থানীরা । ১৬ এপ্রিল আমরা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করি ও ১৭ এপ্রিল মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকি । ৮ মে ভারতের বিহার রাজ্যের সিংভুম জেলার চাকুলিয়া থানায় আমরাই প্রথম চুয়াডাঙ্গা শহরের প্রায় ১৭ জন সহ মোট ১২৫ জন ছাত্র, জনতা,আনসার ও মুজাহিদ ভারতের তত্বাবধানে ৪০ দিন ধরে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সেখানে ৬টি উইংসে ভাগ করে দেয়। প্রত্যেক ভাগে ১৬৫ জন ছিলাম। আমাদের উইং ছিল ৩নং এ। আমাদের উইং মোট ৫ টি স্কোট ছিল। প্রতিটি স্কোটে একবারে ৩৩ জন পিটি করতাম। প্রশিক্ষণ শেষে জুন মাসের ২৩-২৪ তারিখের দিকে সর্বপ্রথম মেহেরপুর গাংনীর কাঁচের ব্রিজ বিনষ্ট করে দিই। এর কিছুদিন মধ্যে কৃঞ্চনগরের নবদ্দীপ হার্টিকালটার বাগান থেকে ভারতীয় কর্ণেল আর কে সিং এবং বাংলাদেশী সুবেদার মেজর আনোয়ার হোসেন ৩টি গ্রুপের কমান্ডারের দায়িত্ব অর্পন করেন আমার উপর। প্রত্যেকটি গ্রুপে ১০ জন করে গেরিলা নির্ধারণ করে দিই ।

গেরিলা কমান্ডার হাফিজুর রহমান বলেন, ৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে আমার নেতৃত্বে আলমডাঙ্গার  বটিয়াপাড়া, শিয়ালমারী, মাজহাদ, রংপুর, দামুড়হুদার শিয়ালমারী, বিঞ্চপুর, ইব্রাহিমপুর, গোপালপুর , লক্ষিপুর, সদর উপজেলার পীরপুর, টেইপুরসহ এই অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা সেল্টার তৈরি করি। ১৮ আগষ্ট আসমানখালী বাজারে রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমণ করি। পরে ৬ই সেপ্টেম্বর আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ রেললাইনের মাইন বিস্ফারণ ঘটাই। ১২সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গা শহরের পেট্রোল পাম্প ধ্বংসকারী এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নষ্ট করে দিই। সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখের দিকে গোকুলখালী ব্রিজ আক্রমণ করে সেখান থেকে বারাদি বাজারে রাজাকার ক্যাম্প ধ্বংস করি। নভেম্বর মাস পুরোটাই বিভিন্ন রকম ছোটখাটো অপারেশন করতে থাকি যার মধ্যে আলমডাঙ্গার আসমানখালি ব্রিজ, হাপানিয়া ও মেহেরপুর গাংণীর মফখোলা ধানখোলা ব্রিজ ধংস্ব অন্যতম।

অপরদিকে জেলার দর্শনা ও দামুড়হুদা অঞ্চল দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমন শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী। এর ফলে চুয়াডাঙ্গা জেলা পুরোপুরি শত্রু মুক্ত হওয়ার পথ সুগম হয়। এর আগে ৫ আগষ্ট  আমার কথা ভুলে গিয়ে হাসান কুষ্টিয়ার নওশের এর কথা শুনে বাগোয়ান মাঠে একটা ইনফরমেশনে অপারেশনে রওয়ানা দেয় এবং সেখানে অনেকক্ষণ হাসানের নেতৃত্বে ১৪ জন গেরিলা অ্যামবুশে পড়ে সন্মুখ সমরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে  দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদহ গ্রামে শাহাদৎ বরণ করেন মুক্তিপাগল আট তরুন, তারেক, হাসান, আফাজ উদ্দীন, খোকন, আবুল কাশেম, রবিউল, রওশন ও কিয়ামুদ্দিন।  

এরপর ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানী বাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহরমুখী মাথাভাঙ্গা নদীর উপর ব্রিজের একাংশ শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়। যাতে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অনুসরণ করতে না পারে। ৭ ডিসেম্বর সকাল পাকিস্তানী বাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহর ও আলমডাঙ্গা অতিক্রম করে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়।

এরপর ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা জেলা পুরোপুরি শত্রু মুক্ত হয়। এদিন স্বতঃস্ফুর্ত মুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গার মাটিতে প্রথম লাল-সবুজ খোচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে।

বর্তমানে ঢাকায় ইমপোর্ট ব্যবসার সাথে জড়িত হাফিজুর রহমান। দেশ স্বাধীকার আন্দোলন ছাড়াও তিনি আবাহনী ক্রীড়াচক্র ক্লাবের সাথে ১৯৭৩ সাল থেকে  জড়িত । এছাড়া তিনি ১৯৭৮-৭৯ সাল থেকে কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সংগঠক, ১৯৯২ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের কোষাধ্যক্ষ ও ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জড়িত ছিলেন। তিনি  ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ক্রিকেট বোর্ডের টুর্নামেন্ট কমিটির সেক্রেটারী ছিলেন । এছাড়াও তিনি  চুয়াডাঙ্গা জেলা সমিতি, রেড ক্রিসেন্ট, চুয়াডাঙ্গা আবুল হোসেন পাবলিক লাইব্রেরী, অরিন্দম নাট্য গোষ্ঠি, সাহিত্য পরিষদ ও শিল্পকলা একাডেমির আজীবন সদস্য।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০