নজরুল ইসলাম: ঋণের নামে আমানতকারীদের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। সেই টাকায় নিজের নামে কিনেছেন ফ্ল্যাট ও জমি, বানিয়েছেন হোটেল। সেই ফ্ল্যাট ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে আবার ভাড়াও দিয়েছেন। জালিয়াতি করে এভাবে চেয়ারম্যান একাই হাতিয়ে নিয়েছেন ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। তার নাম শিহান আবরার চৌধুরী। তিনি ‘দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের’ সাবেক চেয়ারম্যান। তাকে দেয়া ঋণের টাকার আবেদন, অনুমোদন ও তা পরিশোধ-সংক্রান্ত কোনো রেকর্ডপত্রও পাওয়া যায়নি। চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তিনি এসব টাকা অবৈধভাবে ঋণ হিসেবে গ্রহণ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। সেই টাকা দিয়ে নিজ নামে সম্পদ অর্জন করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এসব অনিয়ম উঠে এসেছে। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখন চলছে তদন্ত। দুদক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় ‘দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের’ এসওডি হিসাব থেকে ২০১১ সালের ১৪ জুলাই আফজার হোসেন ও শাহেদা খাতুনের নামে তিন কোটি টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের পক্ষে চেকটি ইস্যু করেন ভাইস চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামসুন নাহার। ওই তিন কোটি টাকা স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রগতি সরণি শাখায় আফজার হোসেন ও শাহেদা খাতুনের নামে পরিচালিত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে একই বছরের ১৭ জুলাই নগদায়নও করা হয়।
তিন কোটি টাকার চেকের বেনিফিশিয়ারি আফজার হোসেন দুদককে জানান, গুলশানে দশমিক ৬৪ কাঠা জমিসহ ছয়তলাবিশিষ্ট ভবনের নিচতলায় কারপার্কিং ও কমন এরিয়াসহ দুই হাজার ১৫০ বর্গফুট আয়তনের ১/এ নম্বরের ফ্ল্যাট। তার স্ত্রী শাহেদা খাতুনের নামে কেনা নিচতলার কারপার্কিং ও কমন এরিয়াসহ একই ভবনের উত্তর-পশ্চিম দিকের দুই হাজার ৩৫০ বর্গফুট আয়তনের ১/বি নম্বর ফ্ল্যাটসহ দুটি ফ্ল্যাট মোট চার কোটি ৫০ লাখ টাকায় শিহান আবরার চৌধুরীর কাছে দুটি সাফকবলা দলিলে বিক্রি করেন। অথচ ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক থেকে দুদককে জানানো হয়, চেয়ারম্যান শিহান আবরার চৌধুরীকে ওই তিন কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেয়া হয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংক গুলশান শাখায় ‘ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের’ নামে পরিচালিত এসওডি হিসাব থেকে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর উইন্ডি টেরেস হোটেলের নামে ছয় কোটি ২৫ লাখ টাকার একটি চেক ইস্যু করা হয়। এই টাকা সিটি ব্যাংক গুলশান এভিনিউ শাখায় উইন্ডি টেরেস নামের হিসাবের মাধ্যমে একই দিন নগদায়নও করা হয়।
অপরদিকে ছয় কোটি ২৫ লাখ টাকার চেকটির বেনিফিশিয়ারি উইন্ডি টেরেসের স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম দুদককে জানিয়েছেন, তিনি ২০০৪ সালের ৪ জুন শিহান আবরার চৌধুরীর কাছে কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা মৌজার ৭ দশমিক ৫ কাঠা ভিটিজমি বিক্রি বাবদ পাঁচ কোটি ৪৪ লাখ টাকা এবং রেজিস্ট্রেশন খরচ বাবদ ৮১ লাখ টাকাসহ মোট ছয় কোটি ২৫ লাখ টাকা পেয়েছেন। জমিটিতে আটতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে পাঁচতলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছিল। সেটিই উইন্ডি টেরেস হোটেল। কিন্তু ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক থেকে দুদককে জানানো হয়, চেয়ারম্যান শিহান আবরার চৌধুরীকে ওই ছয় কোটি ২৫ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দেয়া হয়েছে।
দুদক অনুসন্ধানকালে চেয়ারম্যান শিহান আবরার চৌধুরীকে দেয়া ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার ঋণের আবেদন, অনুমোদন ও তা পরিশোধ-সংক্রান্ত কোনো রেকর্ডপত্র পায়নি। দুদক বলছে, সেই হিসেবে শিহান আবরার চৌধুরী চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ভাইস চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন ও এমডি শামসুন নাহারের সহায়তায় আমানতকারীদের আমানতের এসব টাকা অবৈধভাবে ঋণ হিসেবে গ্রহণ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। সেই টাকা দিয়ে নিজ নামে সম্পদ অর্জন করেছেন।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের তিন কোটি টাকা দিয়ে গুলশানে দুটি ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে। সেই ফ্ল্যাট দুটি আবার মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভের কাছেই প্রতিমাসে ১৫ লাখ টাকায় ভাড়া দেয়া হয়েছে। ঋণগ্রহীতা বিনিয়োগ ও ঋণের টাকা পরিশোধ কোনোটিই করেননি। একইভাবে হোটেলের ক্ষেত্রেও ঋণগ্রহীতা বিনিয়োগ ও ঋণের টাকা পরিশোধ কোনোটিই করেননি।
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দায়ের করা দুদকের মামলায় চেয়ারম্যান শিহান আবরার চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামসুন নাহারকে আসামি করা হয়।
উইন্ডি টেরেস হোটেলের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় উইন্ডি টেরেস হোটেল, কক্সবাজারকে ২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিন তারকা হোটেলের লাইসেন্স দিয়েছে।
উইন্ডি টেরেস হোটেলের সঙ্গে ‘মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের’ কী সম্পর্কÑজানতে চাইলে ‘মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের’ জনসংযোগ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম তুফান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এখন উইন্ডি টেরেস হোটেলের মালিক আবু জাফর চৌধুরী। তিনি মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের চিফ কাস্টডিয়ান। তিনি শিহান আবরার চৌধুরীর বাবা। শিহান আবরার চৌধুরী এখন কানাডায় থাকেন। আগে তিনি এটির মালিক ছিলেন। আর ভাইস চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন ২০২০ কিংবা ২০২১ সালের প্রথম দিকে মারা গেছেন। এসব নিয়ে দুদকে মামলা চলছে।’
আমানতকারীদের ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আপনার মোবাইল নম্বর দিচ্ছি। তিনি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন।’