মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: যশোরের চৌগাছায় বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে মেটে আলুর চাষ। প্রতিকূল পরিবেশের মাঝে লাভের আশায় কখনও কৃষি অফিসের সহযোগিতা নিয়ে আবার কখনও নিজে উদ্যোগে ভিন্নধর্মী ফসল চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন কৃষকরা। তেমনি একটি ফসল অবহেলিত মেটে আলু চৌগাছার চাষিদের দিচ্ছে লাভের সন্ধান। কম খরচে বেশি লাভ হওয়া এবং বাজারে চাহিদা থাকায় ভালো দামও পাচ্ছেন কৃষক। সে কারণে মেটে আলু চাষের প্রতি ঝুঁকেছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। ফলে প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে মেটে আলুর চাষ। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মেটে আলুর বাম্পার ফলনের আশাও করছেন কৃষক।
পুষ্টিগুণে ভরপুর হলেও অবহেলিত সবজি মেটে আলু। অঞ্চলভেদে এ সবজিটি মেটে আলু, পেস্তা আলু, চুপরি আলু, মাচা আলু, গজ আলু, মোম আলু, মাইট্টা আলু, মাছ আলু, প্যাচড়া আলু ইত্যাদি নামে পরিচিত। মেটে আলু আমাদের দেশে মূলত সবজি হিসেবে ব্যবহƒত হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ির চারপাশে, গাছের নিচে, মাচায়, আঙিনায়, বেড়ার ধারে এর চাষাবাদ দেখা যায়। মেটে আলু গরম আবহাওয়ায় ভালো জšে§। ঠান্ডায় গাছ সে ভাবে বাড়ে না, শীতে গাছ শুকিয়ে যায়। হালকা দো-আঁশ মাটিতে মেটে আলু ভালো হয়। যেহেতু মেটে আলু লতা জাতীয় একটি ফসল, তাই বেড়া বা মাচায় চাষ করতে হয়। মেটে আলু ওল, গোল আলু এসব সবজির মতোই ভর্তা, মাছা ও মাংসের সঙ্গে রান্না করে খাওয়া যায়। কীটনাশক ও বালাইনাশক ব্যবহার ছাড়াই এই আলুর চাষ হয়। মেটে আলু ক্যালসিয়াম ও পসফরাসের খুবই ভালো উৎস। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম রয়েছে।
চৌগাছা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলার কিছু এলাকা ছাড়া প্রায় সব এলাকায় কমবেশি মেটে আলুর চাষ হয়েছে, যার পরিমাণ ৮০ হেক্টর জমি। কৃষকরা মূলত দেশি নানা জাতের মেটে আলুর চাষ করেন।
উপজেলার জগদীশপুর, স্বর্পরাজপুর, তেহরি, মির্জাপুর, মুক্তদাহ গ্রামের বিভিন্ন মাঠে কৃষকরা ব্যাপক হারে মেটে আলুর চাষ করেছেন। অধিকাংশ জমিতেই মাচায় চাষ করা হয়েছে, তবে এর জন্য নতুনভাবে কোনো মাচা তৈরি করতে হয়নি কৃষকের। মেটে আলু রোপণের আগে ওই জমিতে ঝিঙে কিংবা উচ্ছের যে মাচা ছিল সেখানেই চাষ করেছেন। ঝিঙে, উচ্ছে ফসল মারা যাওয়ার পর মেটে আলু সেই মাচায় উঠিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে প্রতিটি মাচা মেটে আলুর সবুজ পাতা আর সাপের মতো আঁকাবাঁকা লতা এক অপরূপ সৌন্দর্য বহন করে চলেছে।
কৃষকরা জানান, একটু দূরে দূরে গর্ত করে, সেখানে এ আলু বীজ লাগিয়ে দিলেই কাজ মোটামুটি শেষ। পরের বছর ঘুরে আসতেই প্রতিটি আলু ৮-১৫ কেজি ওজনের হয়। তবে বড় আকারে গর্ত করে ওই গর্তের মাটির সঙ্গে কিছু ছাই, শুকনা গোবর মিশিয়ে দিয়ে সেখানে আলু বীজ রোপণ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
কৃষকরা আরও জানান, এক সময় এ আলু অধিকাংশ মানুষ পছন্দ করতেন না। অথচ এখন এ আলুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাজারে প্রতিমণ আলু পাইকারি এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা করে বিক্রি করছেন।
উপজেলার জগদীশপুর গ্রামের মাঠে মেটে আলু চাষি মজিবর রহমান বলেন, প্রায় এক দশক ধরে এ অঞ্চলের কৃষকরা ফসলের জমিতে মেটে আলুর চাষ করেন এবং ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এ বছর তিনি ১ বিঘা জমিতে মেটে আলুর চাষ করেছেন। তার দেখাদেখি কৃষক রেজাউল করিম ১০ কাঠা, সেলিম রেজা ১০ কাঠা, জমশের আলী ১ বিঘা, গোলাম আলী ১০ কাঠা, আনিছুর রহমান ১৫ কাঠা ও সুলতান হোসেন ১০ কাঠা জমিতে মেটে আলুর চাষ করেছেন।
কৃষকরা জানান, বাংলা সনের বৈশাখ কিংবা জ্যেষ্ঠ মাসে জমিতে মেটে আলুর বিজ বপন করতে হয়। ওই সময়ে জমিতে উচ্ছে কিংবা ঝিঙের চাষ থাকে। এ ফসল মরা যাওয়ার সাথে সাথে মেটে আলুর লতা মাচায় (বানে) উঠিয়ে দিতে হয়। কোনো সার বা কীটনাশক ছাড়াই এটি চাষ হয়। শীতের শুরুতে আলু উঠতে শুরু করে। পোকা মাকড়ের উৎপাত কম সে কারণে কীটনাশক ব্যবহার করা লাগে না। বলা চলে বিনা খরচে ৫ থেকে ৬ মাসে কৃষক এ ফসলের টাকা হাতে পান। ভালো ফলন হলে বিঘা প্রতি ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকার আলু বিক্রি করা সম্ভব। আলু উঠে গেলে ওই জমিত বোরো ধান কিংবা মশুর চাষ করা হয় বলে তারা জানান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সমরেন বিশ্বাস বলেন, মেটে আলু চাষে ব্যয় ও পরিশ্রম দুটোই অন্য যেকোনো ফসলের চেয়ে কম। গত কয়েক বছর ধরেই বাজারে মেটে আলুর দাম ভালো যাচ্ছে। কম খরচে বেশি লাভের কারণে দিন দিন কৃষকের কাছে মেটে আলুর চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উপজেলায় এবার ৮০ হেক্টর জমিতে গাড়ল লতা ও মাছরাঙ্গা জাতের দেশি মেটে আলুর চাষ বেশি হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিস কৃষকদের সব বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছেন বলে জানান কৃষি কর্মকর্তা।