পলাশ শরিফ ও শেখ আবু তালেব: লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ পুঁজিবাজারের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। লেনদেনের হিসাবে দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানটি এক নম্বর অবস্থান ধরে রেখেছে। কিন্তু বর্তমানে এ অবস্থান ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের চার গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাওয়া এবং তাদের সঙ্গে বিশাল অঙ্কের পুঁজি চলে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির শ্রেষ্ঠত্ব এখন চ্যালেঞ্জের মুখে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ সরিয়ে নিয়েছেন বড় গ্রাহকরা। এর জেরে হাউজটির মাসিক টার্নওভার কমেছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে সিকিউরিটিজের আয় কমেছে প্রায় ৬২ শতাংশ। ব্যবসায় পিছিয়ে পড়ায় হাউজের নৈমিত্তিক ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ। অন্যদিকে ওই সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কারণে এ সময়ে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের আয় ও মুনাফা কমেছে।
তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, দেড় বছর আগে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ খায়রুল আনাম চৌধুরী (সোহেল) বিদায় নেন। তারপর চলতি বছরের শুরুতে আরও তিন কর্মকর্তা লংকাবাংলা ছাড়েন। তারা হাল ধরেন অন্য একটি সিকিউরিটিজ হাউজের। শীর্ষ কর্মকর্তারা চলে যাওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রায় তিনশ কোটি টাকার পুঁজি হাতছাড়া হয়েছে। গত কয়েক মাসে তা ৭০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে হাউজটি বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও তার সুফল মেলেনি। প্রায় সাতশ কোটি টাকা বেরিয়ে যাওয়ার বিপরীতে গত কয়েক মাসে মাত্র ৪০ কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগ টানতে পেরেছে হাউজটি। আয় কমায় নিজস্ব আয়ে ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে হাউজটি। সংকট কাটাতে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। চলমান পরিস্থিতি সামলে শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখতে পারবে কি না তা নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে।
লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ ছেড়ে যাওয়া প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ খায়রুল আনাম চৌধুরী (সোহেল) শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি ওই প্রতিষ্ঠান ছেড়েছি অনেক আগে। এখন এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।’
জানা গেছে, লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের মাসিক টার্নওভার কমে ২৫০-৩০০ কোটিতে নেমেছে। বড় বিনিয়োগকারী চলে যাওয়ায় গ্রাহক টানতে বর্ধিত হারে মার্জিন ঋণ দিতে হচ্ছে। সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করতে পারায় প্রতিষ্ঠান ছাড়ছেন বিভিন্ন পর্যায়ের দক্ষ কর্মকর্তারা। বর্তমানে চিফ ইনভেস্টমেন্ট ও চিফ রেগুলেটরি অফিসারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য রয়েছে। দক্ষ জনবলের ঘাটতি হওয়ায় অন্য বিনিয়োগকারীরাও হাউজটির মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে দোটানায় ভুগছেন। ইতোমধ্যেই তারা শেয়ার লেনদেন কমিয়ে হাউজটির ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করছেন বলে কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে।
লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) খোন্দকার সাফাত রেজা শেয়ার বিজকে বলেন ‘কর্মকর্তা চলে যাওয়া-আসা একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত ঘটনা। চলে যাওয়ার পরও কয়েকজন যোগ দিয়েছেন। কিছু বিনিয়োগকারী চলে যেতেই পারেন, এটা তাদের সিদ্ধান্ত। আমাদের নতুন বিনিয়োগও আসছে।’
আয় কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জেরও (ডিএসই) এবারের ট্রেড ভলিউম গত প্রান্তিকের চেয়ে ৬৪ শতাংশ কমেছে। আমাদের কমেছে ৬২ শতাংশ। বাজারের প্রভাব আমাদের ওপরও পড়েছে। এখন দৈনিক লেনদেন ৭০-৭২ কোটি টাকায় নেমে এসেছে আমাদের, যা নিয়মিতের অর্ধেকের চেয়েও কম।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ব্রোকারেজ সেবার ফি ও কমিশন হিসেবে ওই অর্থ আয় করেছে হাউজটি। অন্যদিকে এর আগের বছরের প্রাথমিক প্রান্তিকে এ খাত থেকে প্রায় ৩৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা আয় করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে আয় কমেছে প্রায় প্রথম ৬২ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ২২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অথচ এর আগের বছরের একই সময়ে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের আয় পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় প্রায় ১৪৭ শতাংশ বা প্রায় ২১ কোটি ৭৯ টাকা বেড়েছিল।
এদিকে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের আয় কমার প্রভাব পড়েছে মূল প্রতিষ্ঠান লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের আয় ও মুনাফায়। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রায় ৯২ কোটি আট লাখ টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে নন-ব্যাংকিং আর্থিক এ প্রতিষ্ঠানটি, যা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৮ শতাংশ বা প্রায় ১৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা কম। আর আয় কমায় এ সময়ে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের কর-পরবর্তী মুনাফা প্রায় ৭৩ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ২২ কোটি টাকা। চলমান আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৩০০ কোটি টাকা তোলার ঘোষণা দিয়েছে লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্স। ‘টায়ার টু’ মূলধনের ভিত শক্তিশালী করতে বন্ড ইস্যু করা হচ্ছে।

Print Date & Time : 1 July 2025 Tuesday 9:54 am
লংকাবাংলার শ্রেষ্ঠত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে
পত্রিকা ♦ প্রকাশ: