Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 12:03 pm

ছদ্ম নির্যাতনের শিকার নারী

আবুল কালাম বিশ্বাস: সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত নবদম্পতির জন্য একটি অতি সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত। রত্না ও ফরহাদ এ বিষয়ে পরস্পরের মতামতের প্রতি যে শ্রদ্ধাশীল, তা তাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট। কেউ কাউকে চাপ দিচ্ছেন না। তবে রত্না বুঝতে পারেন, তার স্বামীর মনোভাব হলো দ্রুতই সন্তান নেওয়া। যদিও পরীক্ষা ও চাকরির জন্য প্রস্তুতি ছাড়াও শারীরিক-মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করলে রতœার সন্তান ধারণ আরও কমপক্ষে তিন-চার বছর পরে হলেই উত্তম হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ইচ্ছা (যদিও প্রকাশ্যে নয়) এবং স্বামীর ইচ্ছা আকারে-ইঙ্গিতে যা বোঝা যায়, তা দ্রুতই বাচ্চার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া। এসবের কোনোটিই রতœার পক্ষে এড়ানো সম্ভব নয়।

হালিমা বেগমের তিন ছেলেমেয়ে। দুই মেয়ের পরে ছোট ছেলেটি। হালিমা তার তিন সন্তানকেই সমান চোখে দেখেন। কারও প্রতি আদর-স্নেহ ও সেবা-যতেœ কোনোই কমতি নেই, তারপরও তার শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়স্বজন, এমনকি স্বামীর কাছ থেকেও ছোট ছেলের প্রতি একটু বেশি যতœশীল হওয়ার ইঙ্গিত লক্ষ করেন, যা তার কাছে মোটেও ভালো লাগে না। নিজের সন্তানদের প্রতি সমান মনোযোগ দিতে পারবেন না, আবার সন্তানদের মধ্যে যার সঙ্গে তার মানসিকতা বেশি মেলে, তার প্রতি ন্যূনতম ¯েœহাধিক্য থাকবে না; বরং জোর করে অন্য কারও ইচ্ছায় কাউকে বেশি ভালোবাসতে হবে।

জাহানার খাতুনের তিন ছেলেমেয়ে। প্রথম দুই ছেলে ও মেয়ে চাকরি করেন, আর ছোট ছেলেটি করেন ব্যবসা। সবার অবস্থাই মোটামুটি ভালো। সবাই আলাদা আলাদা বাড়িতে নিজ সংসার নিয়ে বসবাস করেন। স্বামী মোজাফফর আহমেদকে নিয়ে জাহানারা খাতুন গ্রামের ভিটেবাড়িতে থাকেন। বাবা-মাকে দেখাশোনার ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের চেষ্টা রয়েছে। সবাই তাদের খোঁজ-খবর নেন, কাপড়চোপড়সহ মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠান। কিন্তু তারপরও জাহানারা খাতুনের আপসোসÑতার সঙ্গে কোনো ছেলেমেয়ে সময় নিয়ে মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও পরিকল্পনার বিষয়ে খোলামেলা আলাপ করেন না। জাহানারা খাতুনের আপন বোন রহিমা খাতুন জটিল রোগে ভুগছেন, কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিজের আপন ছোট বোনকে চিকিৎসায় সাহায্য করতে পারছেন না। নিজের স্বামী-সন্তানদের নিয়েও জাহানারা খাতুনের ইচ্ছা হয়Ñসবাইকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান করার। কিন্তু ছেলেমেয়েরা নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত যে মা-বাবার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা শোনার সময়ও তাদের নেই। তাই দান-খয়রাত, সাহায্য-সহযোগিতা, পোশাক-আশাক, খাবার-দাবার প্রভৃতি অনেক বিষয়েই জাহানারা খাতুনকে পরিস্থিতি মেনে নিয়ে চুপ থাকতে হয়, যা তার কাছে অসহনীয় লাগে।

রান্নাবান্নার বিষয়ে আফরোজাকে সবসময় পরিবারের অন্য সদস্যদের পছন্দ-অপছন্দকেই প্রাধান্য দিতে হয়। স্বামী-সন্তানদের পছন্দের সব আইটেমই রান্না করতে হয়। কিন্তু তার নিজের পছন্দের আইটেম কী, তা কেউ কোনোদিন জানতে চায় না; এমনকি স্বামী সুলতান সাহেবও নয়। বেলেম্বু দিয়ে ছোট পুঁটি মাছের ঝোল-তরকারি মনে হয় তিনি ছয় মাসের বেশি হলো খাননি, কিন্তু স্বাদ তার জিহ্বায় সর্বদা লেগে আছে। ছোটবেলায় মা তাকে বিশেষ এক ধরনের ঝোল পিঠা খাওয়াতেন, যার স্বাদও তিনি ভুলতে পারেন না। কিন্তু আজ পাঁচ বছরেরও বেশি হলো তার সেটা খাওয়া হয় না। এমনই আরও কত প্রিয় খাবারের পছন্দ তাকে ছাড় দিতে হয় নিজের পরিবারের কাছেই।  

নাসিমা আক্তার সরকারি দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বেসিক ট্রেনিংসহ পদোন্নতি পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে কয়েক ধাপ পদোন্নতিও পেয়েছেন। সবাই জানেন তিনি একজন দক্ষ, সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা। কিন্তু জানা ও তদনুযায়ী মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নাসিমা তার প্রতি এক অদৃশ্য বৈষম্য লক্ষ করেন। গুরুত্বপূর্ণ পেশাদারিত্বের ভাইটাল পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে নাসিমাকে কখনও বিবেচনা করা হয় না। নারী বলে তার প্রতি এক ধরনের অবমূল্যায়ন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তার প্রতি করে, যা নাসিমা বুঝতে পারেন। এমনকি কম গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং পেয়েও তিনি যখন সৃজনশীল উন্নত সেবা প্রদানের মতো উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন, যাতে সেবার মান বৃদ্ধি পায় এবং সেবাগ্রহীতারাও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, তখনও কিছু উল্লেখযোগ্য সহকর্মী নাসিমার ভালো উদ্যোগগুলোর নেতিবাচক দিক খুঁজতে তৎপর হয়ে পড়েন এবং তাকে থামানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করতে থাকেন, যা নাসিমার ব্যক্তিত্বের প্রতি চরম চপেটাঘাত।

সুলতানা পারভীনকে অফিসে বস ও কলিগদের বাজে নজর থেকে রক্ষা পেতে চরম বৈরী পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এমনকি বোরকা পরে থাকলেও সহকর্মীদের কুদৃষ্টি, অঙ্গভঙ্গি ও ইশারা-ইঙ্গিত তার জন্য চরম বিব্রতকর। তিনি না পারছেন প্রতিবাদ করে বসকে শাসাতে, না পারছেন কারও কাছে অভিযোগ করতে! পরিস্থিতি চূড়ান্ত খারাপ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে কষ্ট করে মানসিক নির্যাতন সহ্য করে বিব্রত হওয়া এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হচ্ছে! বিবাহিত ও সন্তানের মা হয়েও যদি তাকে এ রকম আচরণের শিকার হতে হয়, তবে অবিবাহিত স্মার্ট আধুনিক নারীরা কীভাবে অফিস করবে? যারা তার সঙ্গে এমন নোংরা আচরণ করেন, তারা কি মেনে নিতে পারবেন তাদের স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে এমন আচরণ অন্য কেউ করুক?

জেবা পড়াশোনা করে নবম শ্রেণিতে। অষ্টম শ্রেণিতে প্রত্যাশিত ভালো রেজাল্ট করে। নবম শ্রেণিতে ভর্তির সময় বিজ্ঞান, বাণিজ্য বা মানবিক কোন বিভাগে সে পড়বে, তা নিয়ে এক তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। তার নিজের পছন্দ পৌরনীতি তথা রাষ্ট্রবিষয়ক পড়ালেখা। কিন্তু বাবা-মা চান সে ডাক্তার হোক! ডাক্তারি পেশাটা তার একদম ভালো লাগে না। রোগ-ব্যাধি নিয়ে কাজকর্ম তার মোটেই পছন্দ নয়। সে রোগ-ব্যাধিকে ভয় পায়! কিন্তু বাবা-মাকে কীভাবে বোঝাবে? পরিবারে রীতিমতো কান্নাকাটি আর হুলস্থুল অবস্থা। শেষ পর্যন্ত দফারফা হয় বাণিজ্য বিভাগে পড়ার সিদ্ধান্তে, যদিও এই বিভাগও জেবার ততটা পছন্দ নয়। তবু চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা আরকি! জেবার নিজের ইচ্ছার মৃত্যু ঘটিয়ে করে বাবা-মায়ের ইচ্ছায় নিজেকে মানিয়ে নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

নারীর প্রতি প্রকাশ্য নির্যাতনের পাশাপাশি আছে নারীর ওপর ছদ্ম নির্যাতন। এসব নির্যাতনের কিছু মিডিয়াতে আসে। তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ হয় সর্বত্র, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের এসব ঘটনা পুরুষের বাহাদুরিতে পরিণত হয়ে হারিয়ে যায় নারী শরীরের ক্ষত হয়ে! প্রকাশ্য নির্যাতনের বাইরেও নারীর প্রতি এক ধরনের ছদ্ম নির্যাতনও কেবলই নারীর দীর্ঘশ্বাস কিংবা বোবা কান্না হয়ে মিলিয়ে যায় আকাশে-বাতাসে।

এমনিভাবে ক্যারিয়ার, বিয়ের পাত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি টেলিভিশনের চ্যানেল দেখার মতো ছোট-খাটো বিষয় থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়েই নারী প্রতিনিয়ত নিজের মনের বিরুদ্ধে অন্যের চাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে জীবনযাপন করে চলেছেন। নিজের স্বকীয়তাকে নির্বাসন দিয়ে অন্যের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়াই যেন নারীর অমোঘ নিয়তি! কাছের মানুষের দ্বারাই নারী এই ছদ্মনির্যাতনের শিকার বেশি হয়ে থাকে। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, স্বামী, বসÑসবার কাছ থেকেই নারী কমবেশি এমন অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, যা থেকে মুক্তির জন্য নারীর আত্মসচেতনতার পাশাপাশি সবারই সহযোগিতা একান্ত দরকার।

গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালীন পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বেড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। নারীর প্রতি মানসিক নির্যাতনের প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী, যা একটি দেশের উন্নয়নের পথে অন্তরায়। এ মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে ব্যক্তিপর্যায় এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। নারীর আইনগত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে একটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল রয়েছে। নির্যাতিত নারীরা এ সেলের মাধ্যমে বিনা খরচে আইনগত সহায়তা পেয়ে থাকে। এছাড়া দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। দক্ষ বিচারক দ্বারা ওই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নির্যাতিত নারী নিজ জেলা থেকে বিনা খরচে আইনগত সহায়তা পেতে পারে। জরুরি সেবার জন্য ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়া যায়।

সরকারের এসব উদ্যোগের ফলে দেশের নির্যাতিত ও অবহেলিত নারীরা এরই মধ্যে সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে। সরকারি সেবাগুলো প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত সরকারি সেবা গ্রহণ করা এবং অন্যায় ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

পিআইডি নিবন্ধ