দেশের অভ্যন্তরে যে বেশকিছু স্থাপত্যশিল্প রয়েছে তার খোঁজ আমরা কজন রাখি। কাছে থেকেও মনে হয় যোজন দূরে আমরা অবস্থান করছি। কিন্তু সামাজিক বা ধর্মীয় এসব প্রতিষ্ঠানের পেছনে রয়েছে বড় বিস্ময়, বেদনা ও সুখগাথা।
ঝিনাইদহ শহর থেকে ১৪-১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগোলেই চোখ আটকে যাবে বেশকিছু শৈল্পিক নিদর্শন দেখে, মনে হবে কোনো পটু আঁকিয়ের নিপুণ হাতে আঁকা কোনো ছবি। আমরা একেবারেই এসব নয়নাভিরাম ও অপরূপ স্থাপত্য দেখে নয়ন-মন জুড়ানোর ন্যূনতম চেষ্টা করি না, অথচ দূর-দূরান্তের দৃশ্য ও স্থাপনা দেখে আমাদের আফসোসের শেষ নেই। মনে করি, আহা! যদি এমন কিছু আমাদের থাকত! কথায় বলে চেরাগের নিচে নাকি অন্ধকার থাকে। তাই জ্বলন্ত চেরাগ বা প্রদীপের একান্তবর্তী জায়গাটা বেশ অন্ধকার মনে হয় আমাদের কাছে। তেমনই ধর্মীয় প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা জমিদারবাড়ির সাতটি মন্দির কালীমাতা মন্দির, লক্ষী মন্দির, গণেশ মন্দির, দুর্গা মন্দির, তারামণি মন্দির, বিষ্ণু মন্দির ও রাজেশ্বরী মন্দির।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নলডাঙ্গার মন্দিরগুলো হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট। এর মধ্য দিয়ে প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতে পারবে সারা দেশের মানুষ। এমনকি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতেও মন্দিরগুলো ভ‚মিকা রাখতে পারে এমনই দাবি দর্শনার্থী ও এলাকাবাসীর।
ইতিহাস, এলাকার প্রবীণ ও বোদ্ধা মানুষের ভাষ্য, প্রায় পাঁচশ বছর আগে ভট্টরায়ণের এক উত্তরসূরি বিষ্ণুদাস হাজরা নলডাঙ্গার রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। বৃদ্ধাবস্থায় বিষ্ণুদাস ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়ে সন্ন্যাসব্রত নেন। প্রমত্তা বেগবতী নদীর তীরের এক জঙ্গলে তিনি ধ্যান করতেন। ১৫৯০ সালের দিকে মুঘল সুবেদার মানসিংহ বঙ্গবিজয়ের পর নৌযোগে বেগবতী নদীর ওপর দিয়ে রাজধানী রাজমহলে যাওয়ার পথে তার সৈন্যরা পথিমধ্যে রসদ সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধানে বের হয়। বিষ্ণুদাস হাজরাকে সন্ন্যাসব্রত পালন অবস্থায় দেখতে পান তারা। সৈন্যরা বিষ্ণুদাস হাজরার শরণাপন্ন হলে তিনি সৈন্যদের খুব দ্রুততম সময়ে রসদ সংগ্রহ করে দেন। এতে সুবেদার মানসিংহ খুশি হয়ে সন্ন্যাসীকে পার্শ্ববর্তী পাঁচটি গ্রাম দান করেন। এই পাঁচটি গ্রামের সমন্বয়ে প্রথমে হাজরাহাটি জমিদারি এবং ক্রমান্বয়ে তা নলডাঙ্গা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এই এলাকাটি অনেক জঙ্গল, বিশেষ করে নল-নটায় পরিপূর্ণ ছিল বলে স্থানটিকে নলডাঙ্গা নামে অভিহিত করা হয়।
জনশ্রুতি আছে, এরপর প্রায় তিনশ বছর এ বংশের বিভিন্ন শাসক ও রাজবংশের লোকেরা শাসন করেন। শাসকরা বিভিন্ন সময়ে সেবামন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যার বেশকিছু এখন বিলুপ্তপ্রায়। এরপর ১৮৭০ সালে রাজা ইন্দু ভ‚ষণ ক্ষয়রোগে ভুগে মারা গেলে তার নাবালক দত্তকপুত্র রাজা বাহাদুর প্রথম ভ‚ষণ দেবরায় রাজ্যের দায়িত্ব বুঝে পান। তিনিই আজকের এই বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যা কালের সাক্ষী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেগবতী নদীর তীরে।
মন্দির রক্ষা ও বিভিন্ন স্থানে মন্দিরের কল্যাণে ভ্রমণকারী ও নলডাঙ্গা মন্দির সংস্কার কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রশান্ত কুমার অধিকারী জানান, স্থানীয়দের ভাষায় মন্দিরগুলো নলডাঙ্গা মঠ বা নলডাঙ্গার রাজবাড়ি বলে সমধিক পরিচিত। কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে এই প্রাচীন রাজবাড়ি বেগবতী নদীর ধারে বহুকাল ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রশান্ত কুমার অধিকারীর মতে, স্থানীয় লোকজন নিজেদের টাকায় ১৬৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রী শ্রী সিদ্ধেশরী মায়ের মন্দিরসহ কালীমাতা মন্দির, লক্ষী মন্দির, তারা মন্দির ও দ্বিতল বিষ্ণু মন্দির সংস্কার করেন। মূলত প্রশান্ত কুমার অধিকারীর ভাই অতুল অধিকারী ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে প্রত্নতত্ত বিভাগ, ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় দানশীল ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে পাওয়া প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে রাজার চারটি মন্দির সংস্কার করেন। একটি মন্দিরের সংস্কার অর্ধেক হলেও দ্বিতীয় তলার কাজ এখনও বাকি। আরও দুটি মন্দির এখনও সংস্কার করা যায়নি। প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে অনেকে এই রাজবাড়ি দেখতে আসেন।
নলডাঙ্গা জমিদারবাড়ির মন্দির দেখতে আসা তসলিম হোসেন, মণিকান্ত দাস ও মনমোহন আচার্য বলেন, এ মন্দিরগুলোই ঝিনাইদহের বড় সম্পদ হতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর আন্তরিকতা। একটু সহায়তা পেলে এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসবেন দেশ-বিদেশ থেকে। এ মন্দিরগুলো থেকে বছরে লাখ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা রাজস্ব হিসেবে আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন দর্শনার্থীরা। মন্দির দর্শনে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলেও আরও যুগোপযোগী করা প্রয়োজন বলে তারা জানান।
দেলোয়ার কবীর, ঝিনাইদহ