ছয় বছরে নারীদের বিও হিসাব কমেছে ৩৫ শতাংশ

মো. আসাদুজ্জামান নূর: দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছেন নারীরা। বিভিন্ন খাতে বাড়ছে নারী নেতৃত্ব। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও পিছিয়ে রয়েছে পুঁজিবাজার। এ খাতে নারী নেতৃত্বের পাশাপাশি ও প্রত্যক্ষ বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা অনেক কম। দিনে দিনে সেটা আরও কমছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত ছয় বছরে পুঁজিবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে প্রায় তিন লাখের কাছাকাছি বা ৩৫ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার বিনিয়োগের সঙ্গে ঝুঁকির বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারীরা ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত নন বা সাহস করেন না। ফলে পুঁজিবাজার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ অনেক কম। নারী বিনিয়োগকারীদের যে সংখ্যার কথা বলা হয়ে থাকে, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক কম। তাছাড়া পুঁজিবাজার সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন খুব কম মানুষ। তাই নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রচারণা ও শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

পুঁজিবাজারের তথ্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে নারী নিয়োগকারীর সংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ধসের পর পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন প্রায় ২ লাখ নারী বিনিয়োগকারী। ধীরে ধীরে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় পুঁজিবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে।

২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের পুঁজিবাজারে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৪২৪টি। পরের বছরে সেটা কমতে দেখা যায়। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিও হিসাবের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ২১ হাজার ৬০২টি। তবে পরের বছরেই সেটা কিছুটা বেড়ে যায়। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৩৯ হাজার ২১২টি। পরের বছর সেটা কমে সাত লাখের নিচে চলে আসে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে নারী বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৯৬৪টি। এছাড়া ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ লাখ ৬০ হাজার ৩৬৪টি এবং ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৭ হাজার ৩১৫টি। আর চলতি বছরের ৬ মার্চ (বৃহস্পতিবার) এটি দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ১৪ হাজার ২৯০টি। সে হিসাবে গত ছয় বছরের নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবের পরিমাণ কমেছে ২ লাখ ৮০ হাজার ১৩৪টি বা ৩৫ দশমিক ২৬ শতাংশ।

এ বিষয়ে মডার্ন সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি) বলেন, এটা সত্য যে, পুঁজিবাজারের নারীদের অংশগ্রহণ অনেক কম। তবে আগে যে খুব বেশি ছিল, এখন কমে যাচ্ছে এমনটা নয়। বিও হিসাব দিয়ে নারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বিবেচনা করা যাবে না। নারীদের বিও হিসাবগুলো বেশিরভাগই ছিল আইপিও ক্লায়েন্ট। আইপিও নিয়মে বিভিন্ন পরিবর্তনের কারণে বিও হিসাব কমেছে।

তিনি আরও বলেন, অতীতে যেসব নারী বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব ছিল, সেগুলোর পোর্টফোলিও নারীরা নিজেরা ম্যানেজ করতেন না। হয়তো ভাই, স্বামী, সন্তান বা নিকটাত্মীয়রা পরিচালনা করতেন। ফলে বিও হিসাব কমে যাওয়ায় বলা যাবে না যে, নারী বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা কমেছে। তবে শুরু থেকেই আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক কম।

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সঙ্গে ঝুঁকি নিতে হয়। আমাদের দেশের নারীরা চাকরি করতে অভ্যস্ত, ঝুঁকি নিতে নয়। যতই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হোক বা বিভিন্ন খাতে অংশগ্রহণ বাড়লেও আমাদের দেশের পুরুষশাষিত অর্থনীতি প্রচলিত। যার কারণে নারীরা ঝুঁকি গ্রহণের সিদ্ধান্তে পিছিয়ে রয়েছে।

এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রচারণা ও শিক্ষার ওপর জোর দেন খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি)। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে অ্যাডভার্টাইজ করতে হবে। যারা এসব ক্ষেত্রে সফল তাদের নিয়ে প্রোগ্রামের আয়োজন করতে হবে। তারা নারীদের কাছে বার্তাটা পৌঁছাতে পারবে।

অন্যদিকে, পুঁজিবাজারের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান ও স্টেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানের নারী নেতৃত্ব দেখা গেলেও সংখ্যাটা খুব বেশি নয় বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের ২৩টি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে নারী নেতৃত্ব। এদের মধ্যে ১৭টি ব্রোকরেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দুটির চেয়ারম্যান এবং চারটি মার্চেট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন।

জানা যায়, এবি ইস্পাহানী সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান জাহিদা ইস্পাহানী ও শাহ মোহাম্মদ সগির অ্যান্ড কোংয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তাহমিনা জামান। আর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন সিকিউরিটিজের যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারা হলেনÑএডি হোল্ডিংস অ্যান্ড সিকিউরিটিজের ফারজানা আজিম, আলফা ইকুইটিজের আনিকা আঘা, অ্যাসিনজ সিকিউরিটিজের লাইলুন নাহার একরাম, ডিএমআর সিকিউরিটিজের মৈত্রয়ী বিশ্বাস, ফরিদা রাকিব সিকিউরিটিজের ফরিদা রাকিব, এইচ আর সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টের রাইমাহ চৌধুরী, হাজী আহমেদ ব্রাদার্সের আয়েশা দাদা, কে-সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কনসালট্যান্টের দিল আফরোজা কামাল, মইন আব্দুর রশিদ সিকিউরিটিজের জাহানারা আক্তার রহমান, মিরর ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্টের তানজিমা শাহতাজ চৈতি, মডার্ন সিকিউরিটিজের খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি), এসঅ্যান্ডএইচ ইকুইটির হোসনে আরা বেগম, ওয়াইফাং সিকিউরিটিজের ফারহানা ইসলাম (সোনালী), আরএকে ক্যাপিটালের শায়লিন জামান আকবর, মোনার্ক হোল্ডিংসের কাজী সাদিয়া হাসান, থ্রি আই সিকিউরিটিজের আইরিন সুলতানা ও অ্যাসুরেন্ট সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের শিল্পী রায়।

এ ছাড়া মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর এমডি ও সিইও পদে আসীন নারীরা হলেন অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের অমিতা পোদ্দার, এনবিএল ক্যাপিটালের কামরুন নাহার, সিএপিএম অ্যাডভাইজারির তানিয়া শারমিন এবং রূপালী ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক হিসেবে পারসোমা আলম দায়িত্ব পালন করছেন।

শীর্ষ পদগুলোয় নারীদের অবস্থান ও সুযোগ সম্পর্কে খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি) বলেন, পুঁজিবাজারে নারীদের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় থাকতে হবে। তা হলো মেধা ও অর্থ। আমাদের দেশের নারীরা যথেষ্ট মেধাবী। বড় বড় খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পুঁজিবাজার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে এলে নারী বিনিয়োগকারী হিসেবে ও নেতৃত্ব দানের জায়গায় সফল হবেন এবং সেই সুযোগ রয়েছে।

এদিকে পুঁজিবাজারে নারীদের বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ অনেক কম জানিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটসের নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক ড. মাহমুদা আক্তার বলেন, নারীরা এ বিষয়ে জানতে পারেন অনেক কম। তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে আগে তাদের জানতে ও জানাতে হবে। পুঁজিবাজার সম্পর্কে বিআইসিএমে বিভিন্ন কোর্স ও ডিগ্রি চালু রয়েছে। মানুষকে দক্ষ করতে কাজ করছে বিআইসিএম।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০