Print Date & Time : 27 June 2025 Friday 8:41 pm

ছয় বছরে ১৮৬ কোটি ডলারের অলংকার চোরাচালান

আমদানি নিষিদ্ধ হলেও দেশে নিয়মিতই স্বর্ণ চোরাচালান হয়। মাঝেমধ্যে বিমানবন্দরে কিছু ধরা পড়লেও বেশিরভাগ সময়ই তা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা স্বর্ণের এসব চালানের বিস্তারিত কখনোই জানা যায়নি। সম্প্রতি ‘কারনেগি ইনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’ নামক এক সংস্থার গবেষণায় বাংলাদেশে অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানির বিষয়টি উঠে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে শেয়ার বিজ। এ নিয়ে আজ ছাপা হচ্ছে ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী: অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানির পাশাপাশি প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ অলংকারও চোরাচালান হয়ে আসছে বাংলাদেশে। গত ছয় বছরে (২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল) এর পরিমাণ ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ৪৬৫ কেজি বা এক কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ৬৮৪ ভরি। আর এ চোরাচালানের বড় অংশই আসে সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। এছাড়া থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকেও চোরাচালান হয়ে এসেছে অলংকার।

জাতিসংঘের বাণিজ্যবিষয়ক পরিসংখ্যান ‘ইউএন কমট্রেড’-এর তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, ছয় বছরে অবৈধভাবে স্বর্ণালংকার আমদানিতে ব্যয় হয় প্রায় ১৮৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ছয় বছরের মধ্যে পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি অলংকার অবৈধভাবে আসে ২০১৮ সালে। সে বছর দেশে আসে এক লাখ ছয় হাজার ৯০৫ কেজি বা ৯১ লাখ ৬৫ হাজার ৫২৮ ভরি অলংকার। এতে ব্যয় হয় ৩৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এছাড়া ২০১৬ সালে আমদানি করা হয় ২৩ হাজার ৯৯২ কেজি বা ২০ লাখ ৫৬ হাজার ৯৬০ ভরি স্বর্ণ। এতে ব্যয় হয় ১৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর ২০১৪ সালে আমদানি করা হয় ২২ হাজার ১০৫ কেজি বা ১৮ লাখ ৯৫ হাজার ১৭৮ ভরি স্বর্ণ। সে বছর ব্যয় হয়েছিল সর্বোচ্চ ৬৮ কোটি ৫২ লাখ ডলার।

এদিকে ২০১৫ সালে আমদানি করা হয় ১৩ হাজার ৯৩৪ কেজি বা ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৬৩৫ ভরি স্বর্ণ। সে বছর ব্যয় হয়েছিল ১৯ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। এছাড়া ২০১৭ সালে ৯ হাজার ২৩৯ কেজি বা সাত লাখ ৯২ হাজার ১০৮ ভরি অলংকার আমদানিতে ব্যয় করা হয়েছিল ২২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০১৯ সালে ছয় হাজার ২৯০ কেজি বা পাঁচ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৪ ভরি অলংকার চোরাচালান হয়ে আসে এদেশে। এর মূল্য ছিল ২২ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ছয় বছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অলংকার চোরাচালান হয়ে আসে সিঙ্গাপুর থেকে। দেশটি থেকে বাংলাদেশে চোরাচালানের মোট ৫৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ অলংকার এসেছে। এছাড়া আরব আমিরাত থেকে এসেছে ৩৫ দশমিক ২৫ শতাংশ অলংকার ও থাইল্যান্ড থেকে আট দশমিক ৭৭ শতাংশ অলংকার। যদিও স্বর্ণ সবচেয়ে বেশি অবৈধভাবে এসেছিল আরব আমিরাত থেকে (প্রায় ৮৬ শতাংশ)।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক স্বর্ণ আমদানির জন্য কোনো ধরনের এলসি খোলেনি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘স্বর্ণ আমদানিতে এত দিন বাংলাদেশের কোনো নীতিমালাই ছিল না। সম্প্রতি নীতিমালা করেছে সরকার। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু প্রতিষ্ঠানকে নীতিমালার আলোকে এনলিস্টেড করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দিবে। এরই মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান স্বর্ণ আমদানিতে এলসি খুলেছে।’

তথ্যমতে, গত ছয় বছরের সিঙ্গাপুর থেকে অলংকার আসে ১০৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলারের। এর মধ্যে ২০১৯ সালে আমদানি হয় ২২ কোটি ২৬ লাখ ডলার, ২০১৮ সালে ২৫ কোটি ৩৯ লাখ ডলার, ২০১৭ সালে ২০ কোটি ৬০ লাখ ডলার, ২০১৬ সালে ১৬ কোটি ৬৩ লাখ ডলার ও ২০১৫ সালে ১৮ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। আর ২০১৪ সালে স্বর্ণ আমদানি হয়েছিল খুবই সামান্য।

ছয় বছরে আরব আমিরাত থেকে অলংকার আসে ৬৫ কোটি ৭১ লাখ ডলারের। এর মধ্যে ২০১৮ সালে আমদানি হয় ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০১৭ সালে এক কোটি ৬৭ লাখ ডলার, ২০১৬ সালে এক কোটি ৩৫ লাখ ডলার, ২০১৫ সালে ৮৩ লাখ ডলার ও ২০১৪ সালে ৫১ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। তবে দেশটি থেকে ২০১৯ সালে অলংকার আমদানির তথ্য নেই।

এদিকে থাইল্যান্ড থেকে ছয় বছরে অলংকার আসে ১৬ কোটি ৩৫ লাখ ডলারের। এর মধ্যে ২০১৪ সালেই ১৬ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের স্বর্ণ আসে। ২০১৯ সালে আসে এক লাখ ডলারের স্বর্ণ। আর অন্যান্য বছরে খুবই কম স্বর্ণ আসে। এছাড়া মালয়েশিয়া থেকে ছয় বছরে অলংকার আসে চার লাখ ৭৫ হাজার ডলারের, ভারত থেকে সাড়ে তিন ডলারের, যুক্তরাজ্য থেকে দুই লাখ ডলারের ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেড় লাখ ডলারের। এর বাইরে সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস থেকে সামান্য কিছু অলংকার চোরাচালান হয়ে আসে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬ সালে আরব আমিরাত থেকে অলংকার আমদানিতে দ্বিতীয় স্থানে ছিল বাংলাদেশ। আর ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর সিঙ্গাপুর থেকে অলংকার আমদানিতে তৃতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। এছাড়া ২০১৪ ও ২০১৫ সালে এ অবস্থান ছিল তৃতীয়।

উল্লেখ্য, গত ছয় বছরে (২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল) বাংলাদেশে অলংকার ছাড়াও অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি হয়েছে এক লাখ ৭৯ হাজার ৬৯৫ কেজি বা এক কোটি ৫৪ লাখ ১১ হাজার ২৩৫ ভরি। এর পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে গোল্ড পাউডার, অপরিশোধিত ও অর্ধ পরিশোধিত (তরল) স্বর্ণও আমদানি করা হয়। আর সব মিলিয়ে ওই আমদানিতে ছয় বছরে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২৫৫ কোটি ৭৯ লাখ ডলার।