Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 4:47 pm

ছয় বছর বন্ধ কোম্পানি তবু শেয়ারদর ৬৪ টাকা!

সাইমউল্লাহ সবুজ: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি দুলামিয়া কটন স্পিনিং মিলস লিমিটেড। ছয় বছর ধরে কোম্পনিটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। উৎপাদন বন্ধ থাকলেও ঢাকা স্টক একচেঞ্জে (ডিএসই) কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে উচ্চ মূল্যে। এছাড়া গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের পরবর্তী সময় হঠাৎ কোম্পানিটির শেয়ারদর মাত্র তিন কার্যদিসে ১৭ টাকা ৮০ পয়সা বা ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
যদিও এক দশকের বেশি সময় ধরে লোকসানে থাকা কোম্পানিটি লভ্যাংশ দিতে পারছে না সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) দায় করা ২২ কোটি টাকার মামলা এখনও অমীমাংসিত রয়েছে। এছাড়া কোম্পানিটির মোট ঋণের পরিমাণ ৩২ কোটি টাকার বেশি। তবে সম্পদ রয়েছে মাত্র আট কোটি টাকা। এতে দেউলিয়া ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে কোম্পানিটি।
কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের শেষার্ধ থেকে উৎপাদন বন্ধ করে দেয় দুলামিয়া কটন স্পিনিং।

১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি সময়ের সঙ্গে নিজেদের আধুনিকায়নে ব্যর্থ হওয়াকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখিয়েছে কোম্পানিটি। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১ জুন থেকে কারখানাটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে কারখানা রেনোভেশনের উদ্যোগ নেয় কোম্পানিটির পর্ষদ। সম্প্রতি শেনস ক্রপ-সায়েন্স বাংলাদেশ লিমিটেডের কাছে কারখানার একটি অংশ ভাড়া দিয়েছে দুলামিয়া কটন স্পিনিং মিলস। এদিকে ক্রমাগত লোকসানের কারণে বড় ঋণের ফাঁদে পড়ে কোম্পানিটি। ২০২৪ সালে মার্চ শেষে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ কোটি টাকার বেশি। এর বিপরীতে মোট সম্পদ রয়েছে মাত্র আট কোটি টাকা।
বিডিবিএলের করা অর্থঋণ মামলায় ঝুলে আছে কোম্পানিটি। কোম্পানিটির সর্বশেষ বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, দীর্ঘদিন ধরে বিডিবিএল ব্যাংকের ঋণখেলাপির তালিকায় রয়েছে দুলামিয়া কটন স্পিনিং। তৎকালীন শিল্পব্যাংকের কাছে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালের ৩০ ডিসেম্বর কোম্পানিটির ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। পুনঃতফসিল মোতাবেক স্থানীয় ঋণ ও বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ পরিশোধের সময় সীমা ও কিস্তি নির্ধারণ করে দেয় এবং পুঞ্জীভূত সুদ একটি ব্লক হিসেবে স্থানান্তরিত করা হয় এবং তা মূল ঋণ পরিশোধের পর বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে পুনর্বিবেচনা করার কথা উল্লেখ করা হয়। সে হিসেবে কোম্পানি তাদের কিস্তি প্রদান করতে থাকে এবং মূল ঋণের কিস্তি বাকি থাকে এক কোটি ৪০ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং ব্লক সুদ হিসাবে দেখানো হয় সাত কোটি ১৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা। কোম্পানি তার মূলঋণের কিস্তি এক কোটি ৪০ লাখ ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করে। দুলামিয়া কটন বিডিবিএলের নিকট ‘ব্লক সুদ’ হিসাবে রক্ষিত সম্পূর্ণ টাকা কোম্পানির অর্থিক অবস্থার বিবেচনায় একাধিক বার মওকুফের আবেদন করে।

কিন্তু বিডিবিএল তা নাচক করে দেয়। সর্বশেষ বিডিবিএল দুলামিয়া কটন স্পিনিং মিলসের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ মোতাবেক ২২ কোটি ৫৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকা দাবি করে মামলা করে। মামলা উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার জন্য একটি আরবিট্রেশন কমিটি গঠন করে সমঝোতা করার জন্য আদালত আদেশ প্রদান করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সমঝোতার প্রক্রিয়া চলমান আছে। অন্য দিকে দুলামিয়া কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কমিটি বিডিবিএলের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৩৬০ টাকার একটি ক্ষতিপূরণ আদায়ের মামলা দায়ের করেছে, যা বর্তমানে চলমান অবস্থায় আছে।

ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকা কোম্পানিটির শেয়ারদর ৭০ টাকা ৮০ আটকে ছিল। গত ১৮ জানুয়ারি ২০২৪ ফ্লোর প্রাইস উঠে গেলে কোম্পানিটির শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসের নিচে লেনদেন হয়। সবশের্ষ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের পতন হলে কোম্পানিটির শেয়ার চমক দেখা যায়। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৫৭ টাকা ১০ পয়সা, যা ৮ আগস্ট দাঁড়ায় ৭৪ টাকা ৯০ পয়সায়। অর্থাৎ মাত্র তিন কার্যদিবসে শেয়ারদর বাড়ে ১৭ টাকা ৮০ পয়সা বা ৩১ শতাংশ। আর ৮ আগস্ট কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল চলতি বছরের দশ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদিন কোম্পানিটির ১৯২টি ক্রয়াদেশের বিপরীতে রেকর্ড এক লাখ ২২ হাজার ৭৬০টি শেয়ার হাতবদল হয়। পরবর্তী সময় শেয়ারদর ও লেনদেনে নিম্নগতি দেখা যায়। সর্বশেষ গতকাল কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৬৮ টাকা ৭০ পয়সা।

‘জেড’ ক্যাটেগরিতে থাকা কোম্পানিটি গত এক দশকের বেশি সময় ধরে লোকসান গুনছে। লোকসানে থাকা কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পুঞ্জীভূত সঞ্চয় থেকে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ প্রদান করে। এরপর আর লভ্যাংশ দিতে পারেনি। কোম্পানিটির সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তৃতীয় প্রন্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ১৬ পয়সা, যা আগের বছরের একই প্রান্তিকে লোকসান ছিল ১৯ পয়সা। আর তিন প্রান্তিকে (জুলাই ’২৩-মার্চ ’২৪) মিলে লোকসান হয়েছে ৩০ পয়সা, যা আগের অর্থবছরের তিন প্রান্তিক মিলে লোকসান হয়েছিল ৬৫ পয়সা। আর ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়ায় ৩৯ টাকা ৭৬ পয়সা ঋণাত্মক, যা ২০২৩ সালের ২৩ জুন ছিল ৩৯ টাকা ২০ পয়সা।

আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে এক টাকা ৯ পয়সা, যা আগের অর্থবছরে ছিল এক টাকা ১৩ পয়সা। আর ২০২৩ সালের ৩০ জুন কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়ায় ৩৯ টাকা ২০ পয়সা ঋণাত্মক, যা ২০২৩ সালের ৩০ জুন ছিল ৩৮ টাকা ৫১ পয়সা।
মাল্টিমুড গ্রুপের এ প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে আসে ১৯৮৯ সালে। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন সাত কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। বর্তমানে কোম্পানির মোট শেয়ারের ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কোম্পানি পরিচালকদের হাতে, ছয় দশমিক ৮১ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে এবং ৬০ দশমিক ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
দুলামিয়া কটন স্পিনিংয়ের কোম্পানি সচিব কাজী ইকরামুল হক বলেন, কোম্পানির দর বৃদ্ধির কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। তবে অতীতে কোম্পানির শেয়ারের দর আরও বেশি ছিল। এছাড়া বিডিবিএল ব্যাংকের ঋণ-সংক্রান্ত মামলার কারণে নতুন করে ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। এ বিষয় আলোচনা চলমান।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, দুর্বল কোম্পানিগুলোর (জেড ক্যাটাগরি) জন্য বিএসইসির যে নিদের্শনা রয়েছে, তা এই কোম্পানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেনে কোনো প্রকার অনিয়ম পাওয়া গেলে তা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানিটি পরিদর্শন করে কোনো নির্দেশনা দিলে তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।