শেয়ার বিজ ডেস্ক: ট্যানারি মালিকসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করে এবারও চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। গরুর চামড়া ফুটপ্রতি সর্বনিম্ন ৫০ টাকা বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী চামড়ার দাম না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন দিনাজপুরের বিক্রেতারা। চামড়ার মৌসুমি বিক্রেতাদেরও অভিযোগ একই। কয়েকজন বলছেন, দুই টাকা ফুট বিক্রি হচ্ছে ছাগলের চামড়া, আর ১০ থেকে ১২ টাকা ফুট গরুর চামড়া। যদিও চামড়া ব্যবসায়ীদের মতে, সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়েও বেশি দাম চামড়া কিনছেন তারা।
কাঁচা চামড়ার দাম না থাকলে চামড়াজাত পণ্যের মূল্য দিন দিন বাড়ছে। এ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই। চামড়ার আড়তদাররা বলছেন, এটা সম্পূর্ণ সরকার ও বায়ারদের বিষয়।
কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, গত বছর যা ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অপরদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, গত বছর যা ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। অর্থাৎ এ বছর ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট গত বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ পাঁচ টাকা, আর ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ সাত টাকা বাড়ানো হয়। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম ফুটপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
দিনাজপুর জেলার রামনগর চামড়ার বাজারে জেলার ১৩টি উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন এলাকার চামড়ার বেচাকেনা হয়। বলা হয়ে থাকে, এই চামড়ার আড়তটি উত্তরের এই জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। বছরের প্রতিদিনই এখানে চামড়ার বেচাকেনা হয়। তবে কোরবানির ঈদের প্রথম দিন ও দ্বিতীয় দিনে সবচেয়ে বেশি চামড়া আমদানি হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে বাজারে গরুর চামড়ার চাহিদা থাকলেও আগ্রহ নেই ছাগলের চামড়ায়। চামড়া আমদানি হয়েছে, বেচাকেনাও হচ্ছে। তবে দামে খুশি নন বিক্রেতারা। একই কথা বলছেন চামড়ার মৌসুমি বিক্রেতারাও।
১৭ জুন বিকালে ও ১৮ জুন সকালে চামড়ার বাজারে গিয়ে দেখা যায়, চামড়া নিয়ে আসছেন বিক্রেতা। সেই সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে চামড়া কিনে সেগুলো বাজারে বিক্রি করতে আসছেন মৌসুমি বিক্রেতারাও। বাজারে আসার পর সেগুলোর কেনার জন্য আসছেন ব্যবসায়ীরাও। তবে দাম একেবারেই কম।
এই বছরে বাজারে ষাঁড়ের চামড়া বিক্রি হয়েছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে। আর গাই গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে। বড় ছাগলের চামড়া ২০ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হলেও ছোট ছাগলের চামড়ার আগ্রহ নেই কারও। এই বাজারে কোনও ফুট হিসেবে চামড়া বিক্রি হচ্ছে না।
৯০ থেকে এক লাখ টাকার গরুর চামড়া পরিমাপ হয় প্রায় ২০ ফুট। অর্থাৎ এই পরিমাপের চামড়ার মূল্য হওয়ার কথা ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। প্রতি চামড়ায় শ্রমিক খরচসহ আনুষঙ্গিক খরচ আরও ১০০ টাকা বাদ দিলে সেই চামড়ার ক্রয়মূল্য হওয়ার কথা ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। কিন্তু সেই চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে।
তবে বাজারে চামড়ার কাক্সিক্ষত দাম না পেয়ে হতাশ বিক্রেতারা। চামড়ার দাম না পেলেও চামড়ার তৈরি জিনিসপত্রের দাম বেশি, যা নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন তারা। এই চামড়ার টাকার হকদার গরিব ও এতিমদের। ফলে বিষয়টি গুরুত্ব দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
বড়ইল গ্রামের ইসাহাক আলী আসেন চামড়া বিক্রি করতে। তিনি বলেন, আগে যে চামড়া বিক্রি হতো এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায়, সেই চামড়া এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। এই টাকাটা আমরা গরিব-দুঃখী ও এতিমদের দিয়ে দিতাম। একেকটি গরুর চামড়া বিক্রি করেছি দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকায় পর্যন্ত।
শহরের শেরশাহ মোড় এলাকার আশরাফ আলী বলেন, সরকারকে চামড়ার দাম আরও বাড়াতে হবে। খাসির চামড়ার কোনো মূল্য নাই। আমরা আগে ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় পর্যন্ত খাসির চামড়া বিক্রি করেছি।
৩০ বছর ধরে এই বাজারে চামড়ার মৌসুমি ব্যবসা করেন আবু বকর সিদ্দিক। কথা হলে তিনি বলেন, দিন যাচ্ছে আর চামড়ার বাজার খারাপ হচ্ছে। সিন্ডিকেট করছেন চামড়ার ব্যবসায়ীরা। এদিকে সরকারকে নজর দেয়া উচিত। এটা দেশের সম্পদ, ইচ্ছা করে সরকার অবহেলা করছে। এই চামড়া আমরা আগে দুই হাজার চার-পাঁচশ থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকায় পর্যন্ত কেনাবেচা করেছি। তিন বছর থেকে চামড়ার দাম নেই, আড়তদাররা চামড়া কিনছে না। আমরা গৃহস্থের কাছ থেকে কিনে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করতে পারছি না।
চামড়ার আড়তদার ব্যবসায়ী রায়হান বলেন, গত বছরের তুলনায় চামড়ার দাম বেশি। সরকার এবারে চামড়ার প্রতি নজর দিয়েছে। আমরা বেশি দামে চামড়া কিনছি, কিন্তু বেশি দামে চামড়া বিক্রি করতে পারব কি না, সেই চিন্তায় রয়েছি। কারণ লবণের দাম অনেক বেশি। সরকার লবণজাত শিল্প চামড়ার দাম বেশি করলে এই শিল্পটি টিকে যাবে। আমরা ভর্তুকি মূল্যে লবণ পাইনি, কিছু মাদ্রাসাকে দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের চড়া দামেই লবণ কিনতে হয়েছে। ৭০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা লবণ কিনতে হয়েছে এক হাজার ১২৫ টাকায়। ঢাকার ট্যানারির গত বছরের টাকা এখনও পাইনি, এই বছরের টাকা পাব কি না, সেটা নিয়েও চিন্তায় রয়েছি। কিন্তু যেহেতু ব্যবসায়ীÑব্যবসা করার জন্য চামড়া কিনছি।
দিনাজপুর চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপের সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল ইসলাম বলেন, চামড়ার দাম কম, কিন্তু চামড়ার পণ্যের দাম বেশি। এটার কারণ আমরা বলতে পারব না। বায়ারদের সঙ্গে যারা ব্যবসা করে তারাই এটা নিয়ন্ত্রণ করে। সম্পূর্ণভাবে সরকার ও বায়ারদের সঙ্গে যারা ব্যবসা করে, তারাই এটা নির্ধারণ করে। আমরা কাঁচা চামড়া কিনি, লবণজাত করি, আর ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করি। আমরা দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বলে আসছি, সরকারকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। এই চামড়াই আমরা বিক্রি করেছি দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকায়। অথচ এই চামড়া দামই এখন ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। মানে তিন ভাগের দুই ভাগ নেই।