ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ

লেখকঃ রিয়াজুল হক, অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

কুড়ি বছর আগের কথা। গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলের বাংলার শিক্ষক একদিন ক্লাসে তাঁর প্রিয় ছাত্র ফিরোজকে (ছদ্মনাম) জিঙ্গেস করলেন, লেখাপড়া করে কি হতে চায়? ফিরোজের বাবা ছিলেন ভ্যানচালক। নবম শ্রেণীর ফিরোজ সেদিন বলেছিলেন, বাবার ভ্যান চালানো বন্ধ করতে চাই। ফিরোজ এখন একটি বহুজাতিক কোম্পানির বিভাগীয় প্রধান। তার বাবা ভ্যান চালানো বন্ধ করেছে এক যুগ আগে। সন্তানের কারণেই বাবাকে আর শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়না। সমবয়সী মানুষদের সাথে গল্প আর বিশ্রামেই কেটে যায় তার সময়। প্রতিটি ছাত্রের প্রধান কাজ হচ্ছে লেখাপড়া করা। প্রধান কাজ যখন প্রাধান্য পায়, তখন অন্য বিষয়গুলো কখনো সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ব্যতিক্রম কোন ঘটনার বর্ণনায় আমি যাবো না। লেখাপড়াকে ছাত্রজীবনের তপস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। লেখাপড়াই হবে ছাত্রদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য। ছাত্রজীবন নিজেকে গড়ার সময়। আদর্শ মানুষ হিসেবে, ভালো মানুষ হিসেবে। অনেক কিছুর পরিবর্তনের সাথে সাথে ছাত্রজীবনের উদ্দেশ্যও যেন পরিবর্তন হতে চলেছে। ছাত্রদের হাতে এখন অনেক কাজ। লেখাপড়াই যেন গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে লেখাপড়াকে তপস্যার সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে, সেই লেখাপড়া থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। সারা রাত ধরে মোবাইল ফোনে চ্যাটিং করে, সকাল বেলা ক্লাসে গেলে স্যারের কোন কথাই মাথায় ঢোকার কথা নয়। অভিভাবকরাও সন্তানকে দামি উপহার কিনে দেবার মাঝে সাফল্য খুঁজে বেড়ায়।

বিশ-পঁচিশ বছর আগেও মাধ্যমিকে ৩৫/৪৫ ভাগ পরিক্ষার্থী পাশ করত। উচ্চ মাধ্যমিকে এই হার আরো কমে যেত। এখন নব্বই ভাগের উপরে মাধ্যমিকে পাশ করছে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই শোনা যায়, এখন তো পরীক্ষা দিলেই পাশ করা যায়। তবে এতো কষ্ট করে পড়ার দরকার কি? কথায় যুক্তি আছে। না মেনেও উপায় নেই। সার্টিফিকেট অর্জনই যদি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়, তবে রাত জেগে পড়ার দরকার কি? লেখাপড়া করতে হচ্ছে না। হাতের কাছে আছে উন্নত প্রযুক্তি। আজকের স্কুল কলেজে অধ্যয়নরত ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। ইন্টারনেট ছাড়া এসব মোবাইল আবার ব্যবহার অনুপযোগী। কি নেই সেখানে? তবে ভালো কিছু গ্রহণ করার মত বিচার বিবেচনা আদৌ কি এই বয়সী ছেলে মেয়েদের রয়েছে? টেলিফোনের সংস্কৃতি আমাদের সমাজ থেকে এক রকম উঠেই গেছে। থাকলে হয়ত আমাদের সমাজের জন্য কিছুটা ভালোই হত। শিশু কিশোরদের বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ এবং আকর্ষণ দুটোই অনেক বেশি থাকে। তাই মোবাইল ব্যবহারে অনেককে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। তাই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের মোবাইল ফোন দেওয়ার আগে তার বয়স উপযোগী মোবাইল ফোন পছন্দ করতে হবে। শুধুমাত্র যোগাযোগের জন্য বাটন ফোনই যথেষ্ট।

এখন যারা শিক্ষার্থী, তারাই দেশের হাল ধরবে। তাই সবার আগে তাদের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সাবধান করতে হবে সকল প্রকার ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কে। আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনে আজ অনেক ধরনের আগ্রাসনের হাতছানি। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি সকলেরই বেশি আকর্ষণ থাকে। তথ্য-প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার তাদের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। বয়ঃসন্ধিকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই বয়সী ছেলে মেয়েদের প্রয়োজন সঠিক দিক নির্দেশনা। শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরী করে দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিসীম। ছাত্রজীবনে লেখাপড়ার বিকল্প যে কিছু নেই, এটা তাদের বোঝাতে হবে।

সবশেষে ছাত্রজীবনে প্রাপ্ত একটি শিক্ষা দিয়ে লেখাটা শেষ করবো। সপ্তম শ্রেণীতে ক্লাসে একদিন অংকের শিক্ষক পরম শ্রদ্ধেয় মজিবর রহমান শেখ স্যার বলেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রাত জেগে পড়ার জন্য হারিকেনের তেল চোখে লাগিয়ে নিতেন। এতে তাঁর চোখে জ্বলতো এবং ঘুম কেটে যেত। ফলে রাত জেগে পড়তে কষ্ট হতো না। মাদাম কুরি অর্থের অভাবে হোটেলে তিনি থালা বাসন পরিষ্কার করার কাজ করেছেন। কিন্তু লেখাপড়া থামিয়ে দেননি। তিনি দুইবার নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। তাঁরা কেউ আজ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু সবাই তাদের মনে রেখেছে। সবশেষে স্যার বলেছিলেন, তোমাদের লেখাপড়ার এই সময়টা খুব মূল্যবান। এখন সময় যদি নষ্ট করো, তবে জীবনের বাকিটা সময় আফসোস করে কাটাতে হবে। আর লেখাপড়া করলে করার মতো করতে হবে। লেখাপড়া খুব সহজ একটা বিষয়। তোমাদের নিয়ে বাবা-মায়ের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তোমাদের জন্যই তাদের সকল পরিশ্রম। তাদের বৃদ্ধ বয়সে তোমরাই অবলম্বন হবে। কিন্তু সেজন্য নিজেদের সঠিকভাবে তৈরী করতে হবে। তাঁরা যেভাবে চায়, সেই ভাবে নিজেদের গড়ে তোলার চেষ্টা করো। কারণ বাবা-মা কখনো সন্তানের অমঙ্গল চায় না। স্যারের সেই কথাগুলো এখনো যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সবশেষে স্যার বলেছিলেন, ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ । একথা ভুলে গেলে চলবে না।

লেখকঃ রিয়াজুল হক, যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০