Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 11:36 pm

ছাত্ররাজনীতির সুদিন কি ফিরবে না?

 

‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার’। এ যুদ্ধ মানে কারও ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নয়, কোনো কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেয়া নয়। এ যুদ্ধ অন্যায়, অসত্য, অবিচারের বিরুদ্ধে, অধিকার আদায়ের, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতা লাভের এবং সর্বোপরি ইতিবাচক পরিবর্তনের। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, বর্তমান সময়ের তরুণদের ছাত্ররাজনীতি মানেই সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, ছিনতাই এবং মারামারিসহ সকল প্রকার হীনকর্ম। এসব অপকর্ম যেন ছাত্র সংগঠনগুলোর নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ছাত্রদের মধ্যকার প্রতিবাদ করার মুখরতা হারিয়ে গেছে। ন্যায় প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণার নির্ভীকতা হারিয়ে গেছে।

অথচ বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস মানেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। একটা সময় ছিল যখন ছাত্ররাজনীতির বলিষ্ঠ আদর্শগত দিক ছিল। অধিকার আদায়ের লড়াই, সত্যের সাক্ষ্য, অনিয়ম-অনাচারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। জাতীয় রাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত হতো এই ছাত্ররাজনীতি। এর বাস্তব রূপ দেখা যায় ইতিহাসের পরতে পরতে থাকা জনমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। ’৫২ থেকে ’৯০ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন ছিল এ দেশের জাতীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি। নৈতিকতাবোধ কিংবা মূল্যবোধ, মানবিকতাবোধ, সহমর্মিতাবোধ, কৃতজ্ঞতাবোধ, সহনশীলতা, প্রজ্ঞা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, দেশপ্রেম তথা সমস্ত প্রকার সৎগুণ নিয়ে ছাত্ররাজনীতি চলত তার আপন গতিতে।

ছাত্ররা রাজনীতি করত ঠিকই কিন্তু নিজেদের অবস্থানকে রাখত পরিচ্ছন্ন। তাদের বড় পরিচয় ছিল ছাত্র। এই পরিচয়কে তারা কখনও কলুষিত করেনি। তাদের প্রতিটি আন্দোলনে, সংগ্রামে মেধা ও মননের স্পর্শ ছিল। স্বাধীনতার পর দেশে চলতে থাকে ক্ষমতার পালাবদল। তবুও ছাত্ররা তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। স্বৈরাচারী আন্দোলনে তারা ছিল সরব। ফলে সকল বাধা ডিঙিয়ে ১৯৯০ সালে দেশে গণতন্ত্রের নতুন অভ্যুদয় সংঘটিত হয়। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাবির স্যার এফ রহমান হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যান ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিক। ২০১৭ সালের ৭ মে আবু বকর সিদ্দিক হত্যাকাণ্ডের রায়ে সকল আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়।

বিশ্বজিৎ বা বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সবাই  কমবেশি জানেন। প্রকাশ্য দিবালোকে প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছাত্রলীগ নেতারা বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল। বাকস্বাধীনতা, নিজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি সাংবিধানিক অধিকার। অতীতে যেই ছাত্ররাজনীতি হতো অধিকার আদায়ের জন্য, আজকে সেই ছাত্ররাজনীতিই হচ্ছে অধিকার ভোগের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি বুয়েটে আবারও ছাত্ররাজনীতি চালু করার পাঁয়তারা চলছে। বুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবি, তাদের ৯৯ শতাংশই চান না যে, বুয়েটে আবারও রাজনীতি ফিরে আসুক। এর মধ্যেই এক ছাত্রলীগ নেতার রিটের প্রেক্ষিতে বুয়েটে রাজনীতি চলবে বলে নির্দেশনা জারি করেছেন উচ্চ আদালত। ফলে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে সৃষ্ট পরিস্থিতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরাÑযেন বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ঢুকতে না দেয়া হয়। মেধাবীদের আবাসস্থল বুয়েট দেশ গড়ার কারিগর তৈরি করবে নাকি আবারও ছাত্ররাজনীতির নামে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে অতীতের সেই সুস্থধারার রাজনীতির নিশ্চয়তা দিতে পারলে আশা করা যায় পরিবেশ ও পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেবে। কিন্তু এমনটা সম্ভব কি না সেটা মুখ্য প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এখন প্রশ্ন ওঠে, তবে কি আর সেই সোনালি ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না?

ছাত্ররাজনীতির সেই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হলে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে সচেতন হতে হবে। তারাই ছাত্ররাজনীতির অভিভাবক। অতএব তাদের ভূমিকাই মুখ্য বলে মনে করি। দ্বিতীয়ত, ছাত্রদের সঠিক রাজনৈতিক ইতিহাস জানার সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের জানতে হবে, কীভাবে তাদের পূর্বসূরিরা বিভিন্ন আন্দোলনে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে হলেও দেশের স্বার্থে কাজ করে যেত। তৃতীয়ত, ছাত্রদের মেধার যথাযথ বিকাশ ঘটার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো যেন যথার্থ জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে নিরাপদ জায়গা হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত, ভোগে নয় ত্যাগেই সুখ, এই মন্ত্রে প্রতিটি ছাত্রকে উজ্জীবিত করে তুলতে হবে। পঞ্চমত, ন্যায় ও নৈতিকতা শিক্ষা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করতে হবে।

 

তারেক খান

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জ