Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 11:47 am

ছাত্র আন্দোলন, রাজনীতি ও অভিভাবক

ছাত্রদের প্রধান কাজ হলো পড়াশোনা করা। ঠিকমতো ছাত্রত্ব বজায় রেখে লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়া। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা মেনে চলা। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে দূরত্ব তৈরি না করা। ছাত্র ও শিক্ষক একে অপরের সহযোগী। শিক্ষকের কাছ থেকে ছাত্র ক্লাসের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও পাঠ অর্জন করবে। শিক্ষক তৈরি থাকবেন ছাত্রকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান প্রদান করতে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষক, দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জাতীয় ও বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অভিভাবকরা সন্তানদের পড়ালেখার খরচের জোগান দেন।

একসময় শিক্ষার্থীরা ছাত্র পড়িয়ে নিজেদের পকেট খরচ নির্বাহ করত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে এভাবে উচ্চশিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করেছিল। এখন এলাকায় এলাকায় কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। যে ছাত্ররা লজিংয়ের মাধ্যমে পড়াশোনা চালাত, এখন তারা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরাও কোচিং সেন্টারনির্ভর শিক্ষা অর্জন করছে, অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে টিউশন ফি দিয়ে শিক্ষা নিচ্ছে। অবশ্যই সেখানে প্রচুর অর্থ অভিভাবককে গুনতে হয়। অর্থ ছাড়া শিক্ষা আর চিকিৎসা কিছুই কোনো প্রার্থী পাবে না। বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থায় যত ধরনের আধুনিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, সবগুলোতেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করতেই হচ্ছে। অর্থ খরচ ছাড়া প্রাইমারি লেভেল থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কোথাও শিক্ষা পাওয়া দূরের কথা, বেশিরভাগ মানুষের ব্যবসা ও আয়-ইনকাম হচ্ছে সীমিত। তবুও জমি-জমা বিক্রি করে বা বন্ধক রেখে অনেকেই সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠান। তার সন্তান লেখাপড়া করবে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে এবং একদিন সেখান থেকে বড় ডিগ্রি নিয়ে বের হবেÑসে স্বপ্ন সব অভিভাবক দেখে থাকেন। বড় ডিগ্রি নিয়ে বের হয়ে সে একটা চাকরি খুঁজে নেবে, তারপর পরিবারকে কিছুটা হলেও সাহায্য-সহযোগিতা আর্থিকভাবে করবে, এমনটিই অনেক অভিভাবক মনে করে থাকেন।

এরই মধ্যে অনেক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা আন্দোলন, ছাত্রসংঘাত ও রাজনৈতিক কারণে অকালে মৃত্যুবরণ করে। এদেশের মানুষ কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে তার প্রিয় সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেসরকারি ছাত্রদের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে কোনো অর্থ খরচ করা হয় না। যারা অর্থ খরচ করে সন্তানদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন, তাদের সন্তানদের আন্দোলনমুখী করে যারা নোংরা রাজনীতি করছে, অভিভাবকরা তাদের ঘৃণা করেন। শিক্ষকদের উচিত শিক্ষাকেন্দ্রে রাজনীতি না করা এবং ছাত্রদের রাজনীতিতে ঠেলে না দেয়া।

কভিডকালে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান খোলা আছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব চলছে। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, অন্যান্য শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যমেলা বা মার্কেট সবই খোলা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদি সব ধরনের অফিস-আদালত, বাণিজ্যমেলা ও মার্কেট চলতে পারে, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার যুক্তি কী? গণপরিবহনের জন্য সরকার আইন করলেও তারা নিজেদের মতো করে গণপরিবহন চালাচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক চললেও বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রাখতে যত সমস্যা! আবার সরকারি উচ্চশিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে বিভিন্নভাবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মতো করে সবকিছু চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পরীক্ষা এবং শিক্ষা থেকে দূরে রাখা হয়েছে। এতে করে তারা সেশন জটের মধ্যে ধাবিত হচ্ছে। কভিড কি শুধু তাদের জন্যই। সরকারের তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ লেভেলের ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করেছে। টিকা প্রদান এখন প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। টিকা যখন ছোট-বড় সব বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অব্যাহতভাবে দেয়া হচ্ছে, তখন মহামারির ভয়ে শুধু নির্দিষ্ট পরীক্ষা ও ক্লাস বন্ধ করার কী কারণ থাকতে পারে, তা নিয়েও অভিজ্ঞ মহলে জোর আলোচনা চলছে।

সরকারকে একটা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও পরিকল্পনার মধ্যে চলা দরকার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বয়স দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। চাকরির বয়স চলে যাবে। আফসোস আর হতাশার মধ্যে তাদের জীবনে নেমে আসবে অশান্তি আর ভোগান্তি। এর পেছনে দায়ী কারাÑশুধু কভিড-১৯-এর দোষ দিয়ে লাভ নেই। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ বা হেতু আছে কি না, তাও ভেবে দেখতে হবে। ছাত্রদের জীবন নিয়ে কোনো অভিভাবক কাউকে খেলতে দেবেন না। তাদের কাজ তাদের করতে দিন। ক্ষমতার পরিবর্তন অথবা কাউকে ক্ষমতায় ওঠানো তাদের কাজ নয়। তাদের শিক্ষাজীবন সময়মতো শেষ করার জন্য সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। তারা যেন সময়মতো কর্মজীবনে সুষ্ঠুভাবে আত্মনিয়োগ করতে পারে, সে সুযোগ তাদের জন্য তৈরি করে দেওয়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কর্মসংস্থান তৈরি করুন। ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন, বেকারত্ব দূর করবেনÑএমন প্রতিজ্ঞা আপনাদের ছিল, সেটা বাস্তবায়ন করুন। অহেতুক ছাত্রদের ঝামেলার মধ্যে ছেড়ে দেবেন না। আর তাদের আন্দোলনে মাঠে নামিয়ে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। সাধারণ মানুষ এসব মোটেও পছন্দ করে না। ছাত্রদের ক্লাসে ফিরে যেতে সহযোগিতা করুন। তাদের যেন দেশের কোনো আন্দোলনের জন্য ইস্যু করা না হয়। সুখী-সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়তে আমাদের উচিত ছাত্রদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় এগিয়ে আসা।

মাহমুদুল হক আনসারী

মুক্ত লেখক

mh.hoqueansari@gmail.com