রুহুল আমিন: গণমাধ্যমের তথ্য, স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর বিভিন্ন জায়গায় পদত্যাগের হিড়িক লেগেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও এর সংখ্যা নিহাত কম নয়। দেশের প্রায় ৪৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য শূন্য হয়ে পড়েছে। উপাচার্য পাশাপাশি উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, ডিন, প্রক্টর ও হলের প্রভোস্টরা পদত্যাগ করেছেন। কেউ স্বেচ্ছায় কেউ আবার চাপের মুখে পরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। সরকারের পতনের প্রভাব শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়েছে এমন নয়। দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজেও এর প্রভাব পড়েছে।
শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে পড়ে প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষরা পদত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। পদত্যাগের বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেকই মতামত দিচ্ছেন। শিক্ষকরা জাতি গঠনের মূল কারিগর। বাবা-মায়ের পরেই শিক্ষকদের স্থান। শিক্ষকরা সমাজের মুকুট। তাদের অপমান অপদস্ত তা আমার হƒদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ব্যাথিত হয়েছি জাতির কারিগরদের সঙ্গে এমন আচরণের জন্য। কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতা মনে পড়ে। বাদশাহ আলমগীরের এক ছেলে শিক্ষক ছিলেন দিল্লির এক মৌলবি। একদিন শিক্ষককে অজুর পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন শাহাজাদা। আর মৌলবি নিজ হাতে তার শরীর পরিষ্কার করছিলেন। দূর থেকে বাদশাহ সেই দৃশ্য দেখেন। শিক্ষকেকে ডেকে নিলেন রাজদরবারে। শিক্ষক ভাবলেন, আজ তার রেহাই নেই। বাদশাহ আলমগীরের শাস্তির কথা ভেবে মনে ভয় পেলেন।
শিক্ষককে বাদশাহ বললেন, আপনি আমার ছেলেকে কি শিক্ষা দিয়েছেন যে, সে আপনার হাত-পা না কচলিয়ে দিয়ে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পানি ঢালছিল এ কেমন আদব শিক্ষা দিয়েছেন আপনি ছাত্রকে। যুগে যুগে শিক্ষকদের মাথা উঁচু ছিল। কিছুদিন আগে পত্রিকার খবরে জানা যায়, ছাত্রকে শাসন করায় এক শিক্ষককের গায়ে হাত তুলেছেন তার অভিভাবক। অথচ একসময় অভিভাবকরা আগেই শিক্ষকদের বলে দিতেনÑ ‘আমার ছেলের শরীরে মাংস আপনার, হাড্ডি আমার।’ এর মাধ্যমে শিক্ষকদের শাসন করার অধিকার দিতেন অভিভাবক। বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের এমন অবস্থার কারণ কি? সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ছাত্ররা জোর করে পদত্যাগ করাতে গেলে এক শিক্ষক সেখানে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
শিক্ষক রাজনীতিই শিক্ষকদের অপদস্ততার মূল কারণ? শিক্ষকরা লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ দখলের চেষ্টা করছে। গত কয়েক বছরে সরকারদলীয় শিক্ষকদের বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে তার যোগ্যতা এবং দক্ষতাকে বিবেচনা না করে বিবেচনা করে হয়েছে সে সরকারের বশংবদ কি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বিভিন্ন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক সব নিয়োগ হয়েছে রাজনৈতিকভাবে। নিয়োগকৃত শিক্ষকরা সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করেছেন। দুর্নীতি করে নিজেরা সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছেন। ভিন্নমতের শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার করেছেন। দলীয় শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো। তারা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আবাসিক হলগুলো বর্গা দিতেন। হলে ছাত্রদের সিট দেয়ার ক্ষমতা ছিল রাজনৈতিক নেতাদের কাছে। তারা এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে হলে সিট বাণিজ্যসহ নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত ছিল। রাজনৈতিক মতাদর্শে শিক্ষকরা লাল, নীল, সাদাকালোসহ বিভিন্ন ফোরাম কোরামে বিভক্ত হয়েছেন। তাদের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছাত্রদের পড়ালেখার প্রতি না হয়ে হয়েছিল কীভাবে দুর্নীতি করে টাকা পয়সা কামানো এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা।
ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো শিক্ষককে বিভাগে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ব্যানার-পোস্টার ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে না আসলে বাসায় গিয়ে হেনস্তা করা হচ্ছে। অনেক শিক্ষক নিজের নিরাপত্তা শঙ্কা থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন না। কেউ কেউ আবার ভয়ে বাসা থেকে পালিয়েছেন। যারা এ রকম পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন তাদের বেশির ভাগ শিক্ষক গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তারা প্রশাসনিক বিভিন্ন দায়িত্বে থেকে শিক্ষার্থী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অনিয়মের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। কেউ বলছেন এটি তাদের অপকর্মের ফসল। এর বিপরীত দিকও আছে যেসব শিক্ষক আন্দোলনের পক্ষে ছিল তারা বিভিন্নভাবে প্রসংশার জেয়ারে ভাসছেন।
সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষকে জোর করে ছাত্রদের দ্বারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। অধ্যক্ষ মহোদয় বয়স্ক এবং মুখে দাড়ি। তার পদত্যাগ করানোর ভিডিও দেখে আমার হƒদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তারও তো পরিবার-পরিজন আছে। কিন্তু একটু পর তার কৃতকর্মের একটা লিস্ট দেখতে পাই যেটি আসলে তার পদত্যাগ করানোর পেছনে মূল কারণ। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যানার-পোস্টারে তার নাম। ফেসবুকে শিক্ষার্থী নির্যাতনের পক্ষে পোস্ট এবং কমেন্টসের স্কিনশর্ট সম্বলিত বিভিন্ন পোস্ট। তার কৃতকর্মে তার অপদস্ততার জন্য দায়ী। আমি তার পদত্যাগ করানোর পক্ষে সাফাই গাইছি না। কারণ শিক্ষকরা এই সমাজের মুকুট। তারা জাতি গড়ার মূল করিগর। তাদের থেকে জাতি শিক্ষা নেবে কিন্তু তারাই বিপথগামী হয়ে পড়েছে। শিক্ষকরা সত্য কে সত্য মিথ্যা কে মিথ্যা বলতে পারেরনি। তারা অনিয়ম, অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্য, জুলুমের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াইনি। তার পদলেহন করেছেন ক্ষমতার জন্য, নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনকে লেলিয়ে দিয়েছে ছাত্রদের বিভিন্ন যৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে। নিজ দলের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে দূরত্ব তৈরি করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। অন্যায়ভাবে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন রাজনীতি এবং পেটনীতির ওপর ভিত্তি করে।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর এই মেরুদ্বন্দ তৈরি করার কারিগর মহান শিক্ষক। মহান শিক্ষকদের কাছে থেকে শিক্ষার্থীরা নীতি নৈতিকতা আচার-আচরণসহ যাবতীয় কিছু শিখবে। শিক্ষকদের আইডল হিসেবে নিয়ে তাদের মতো জীবন গড়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু শিক্ষকরা যদি হয় টাকায় নিয়োগ, পদলেহন ব্যাস্ত তাহলে তাদের কাছে থেকে কি শিখবে ছাত্ররা? এ প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যদি বিভিন্ন দিবসে শহীদ মিনারে ফুল আগে পরে দেয়া নিয়ে ছাত্রদের সামনে নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি করে। তারা যদি ছাত্রলীগ নেতার কাছে পিস্তল চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে খবরের কাগজের শিরোনাম হন। তাদের দুর্নীতির ফোনালাপ যদি দুইদিন পরপর ফাঁস হয়। ছাত্রীদের কে বেশি নম্বর দেখিয়ে অনৈতিক প্রস্তাবের ফোনালাপ ফাঁস হয়। শিক্ষকদের আলমারি থেকে যদি পুতুল বের হয়। এসব শিক্ষককের কাছে থেকে জাতি কি শিখবে? সব শিক্ষক এমন নন। এর মধ্যে অনেক বিবেকবান ভালো শিক্ষক সমাজে বিরাজমান।
জাতির মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের সর্বদা মনে রাখতে হবে, কারও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন তার কাজ নয়। শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে মেধার ভিত্তিতে রাজনৈতিক নেতা বা অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে নয়। প্রতিষ্ঠানিক এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়োগ করতে হবে দক্ষতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক মতাদর্শে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কলেজের অধ্যক্ষ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানিক প্রধানরা যেন নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য একটা বলয় তৈরি করে অনিয়ম এবং দুর্নীতি না করতে পারে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলগুলোতে যেন রাজনৈতিক পরিচয়ের পরিবর্তে মেধার ভিত্তিতে সিট বণ্টন করতে হবে। শিক্ষকদের রাজনৈতিক সাদা, কালো, লাল, নীল, ফোরাম, কোরামের পরিবর্তে মূল লক্ষ্য থাকতে হবে শিক্ষার্থীদের দিকে। বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের এমন আচরণের পেছনে নিপীড়িত অনেকেই উস্কানি দিচ্ছে। উস্কানি দিয়ে তারা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে। উসকানিদাতাদের মনে রাখতে হবে অন্যায়ভাবে কোনো কিছু অর্জন করতে গেলে বা কোন নিয়ম তৈরি করলে সেটির পরিণাম ভবিষ্যতে আরও খারাপ হতে পারে। নিজেও এর ভুক্তভোগী হতে পারে।
অন্যরা যা করছে আপনিও যদি তা করেন তাহলে তাদের সঙ্গে আপনাদের পার্থক্য কোথায়? শিক্ষার্থীদের আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিতে হবে। শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের এমন আচরণ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। কেউ যদি অপরাধী হয়ে থাকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিন। কাজ না হলে তারপর আন্দোলনের পথ বেছে নিতে পারেন। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা ইতিহাসে বহু শিক্ষকের ত্যাগের কথা আমরা জানি। স্বার্থান্বেষী গুটিকয়েক শিক্ষকের জন্য যেন যেন জাতি গড়ার মূল করিগররা যেন প্রশ্নের মধ্যে না পড়েন। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরুরা যেন অপমান অপদস্ত না হন, শির উঁচু করে সমাজে থাকুন, এটিই প্রত্যাশা।