কৈশোর যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে

মো. ইমরান হোসেন: মিডিয়াতে চাকরি করার একটি সুবিধা হচ্ছে, সবাই যেন এক পরিবারে গাঁথা। এখানে সহকর্মীদের মধ্যে আন্তরিকতা তুলনামূলক বেশিই। পরিবারে বড় ভাই যেভাবে ছোট ভাইদের সঙ্গে আচরণ করেন, মিডিয়াতে জুনিয়ররা সিনিয়রদের কাছ থেকে ঠিক তেমন স্নেহ পেয়ে থাকেন। তবে পাঠকের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়ার পেশাগত দায়িত্বের কারণে একসঙ্গে সবাই ছুটি কাটাতে পারেন না। সাপ্তাহিক ছুটির বেলায় রয়েছে ভিন্নতা একেক জনের একেক দিন। ঈদ কিংবা অন্য ছুটিতে যে যার পরিবারের সঙ্গে সময় কাটায়। ইচ্ছা থাকলেও তাই আমরা একসঙ্গে দূরে কোথাও যেতে পারি না।

এ তো গেলো আমাদের কিছু অপূর্ণতার কথা। তবু একে অপরের কাছে থাকার সময়টুকু বের করে নিতে চাই আমরা। হয়তো তাই এবার সময় হয় কাজের বাইরে একসঙ্গে সময় কাটানোর। পবিত্র আশুরায় ছুটি পেয়েছিলাম আমরা। ঠিক এই সময় বাংলাদেশ নিউজপেপার-মিডিয়া কম্পিউটার এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন পত্রিকার চাকরিজীবীদের নিয়ে ঘুরে আসার উদ্যোগ নেয়। ঘুরে আসার ইচ্ছা তো আগে ছিলই। সোনায় সোহাগা যাকে বলে আরকি! একসঙ্গে সময় কাটানোর দিন নির্ধারণ করা হয়। বেছে নেওয়া হয় ১ অক্টোবরকে। স্থান নন্দন পার্ক। সঙ্গে যুক্ত হয় সবার ফ্যামিলি। আয়োজন করা হলো ফ্যামিলি ডে।

ওইদিন ঘুম ভাঙে শেখ মোহন ভাইয়ের ফোনে। ওপাশ থেকে তিনি ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বললেন, এখনও ওঠোনি, সাড়ে ৬টা বাজে। আমাদের গাড়ি ছাড়বে সকাল সাড়ে ৭টায় জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে। তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিই। ইতোমধ্যে মোহন ভাই বাসার সামনে রিকশা নিয়ে হাজির। দ্রুত তার সঙ্গে প্রেস ক্লাবের সামনে পৌঁছাতেই দেখি সবাই এসে গেছেন। আমাদের বড় ভাই জহির ইলিয়াস খান তার পুরো পরিবার নিয়ে হাজির। রাকিবুল ইসলাম, রুহুল আমিন, আরিয়ান সোহেল, আবু সাঈদ তুহিন, সাব্বির আহমেদ, মনজুরুল ইসলামসহ সব বন্ধু হাজির। নির্ধারিত সময়ের পরে গাড়ি ছাড়ে ৯টায়।

সরকারি ছুটির দিন থাকায় রাস্তা ছিল ফাঁকা। একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করে সবার মাঝে। এর আগে আমাদের অনেকে নন্দন পার্কে যাননি, তাই আগ্রহটা একটু বেশিই ছিল। যেহেতু সবার পরিবার এক গাড়িতে তাই অন্যরকম মজা পাচ্ছিলাম। দেখতে দেখতে অল্প সময়ের মধ্যে সাভার পার হলাম। নন্দন পার্কের কাছাকাছি চলে এসেছি।

নন্দন পার্ক রাজধানীর অদূরে সাভার উপজেলায়। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম বিনোদনমূলক পার্ক। আশুলিয়া থানার নবীনগরে চন্দ্রা মহাসড়কের পাশে বাড়ইপাড়া এলাকায় এর অবস্থান। ১৩৫ বিঘা আয়তনের মনোরম এই পার্কটি যুক্তরাজ্য থেকে প্রযুক্তি ও ডিজাইন নিয়ে ভারতের নিকো পার্কের সহায়তায় নির্মিত হয়েছে।

পার্কে পৌঁছানোর পর আমাদের হাতে প্রবেশ টিকিট আর এখানকার রাইডগুলোর টিকিট ধরিয়ে দেন আয়োজকরা। টিকিটটা একটি প্যাকেজ ছিল, যার মূল্য নির্ধারিত ছিল ৬১০ টাকা। টিকিটটা তিনটি অংশ বিভক্ত ছিল। প্রথম কপি, দ্বিতীয় কপি ও তৃতীয় কপি। দ্বিতীয় কপিটা গেট দিয়ে প্রবেশের সময় ছিঁড়ে নেয় পার্ক কর্তৃপক্ষ। প্রথম কপিতে ছিল ১০টি রাইড। আর তৃতীয় কপিতে ওয়াটার ওয়ার্ল্ড। সঙ্গত কারণে আমরা এতটাই উত্তেজিত ছিলাম যে, কোথায় প্রথমে যাব তা ভাবার সময়ও পাচ্ছিলাম না। একেক জনের মত একেক রকম। কেউ বলে এদিকে, কেউ বলে অন্যদিকে। অবশেষে সবার সিদ্ধান্তে একদিকে গেলাম।

প্রথমে চলে যাই ‘কেবল্ কার’ রাইডের দিকে। উঁচু আকাশে তারের মাধ্যমে কিছু গাড়ি একদিকে যাচ্ছে, আবার কিছু অন্যদিক থেকে ফিরে আসছে। দেখতে ভালো লাগছে। আগে কখনও কেবল্ কারে চড়িনি। রাইডের সামনে লম্বা লাইন। আমাদের সামনে প্রায় ১০০ মানুষ। প্রায় ৪০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে কেবল্ কারে উঠি। কেবল্ কার চলা শুরু করেছে। শূন্যে ভাসছি। তখনকার অনুভূতিগুলো বোঝাতে পারবো না। কেবল্ কারের মধ্যে সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত। ওখান থেকে নেমে ‘প্যাডেল বোট’-এর দিকে যাই। প্যাডেল বোট চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল আগেই। এবার ভিন্ন স্বাদ নেওয়ার পালা বন্ধুদের সঙ্গে। আমরা তিন বন্ধু প্যাডেল বোটে উঠে পড়ি। অন্য বন্ধুরাও ভিন্ন বোটে উঠেছে। কেউ ইচ্ছা করে আমাদের বোটে ধাক্কা দিচ্ছে। মনে হচ্ছি, কিশোর বয়সে ফিরে গেছি। প্রায় ২০ মিনিটি বোট চালানোর পর ‘মুন রেকার’-এর দিকে যাই। ওখানেও ভিড় ছিল সেদিন। অপেক্ষার পর ওঠার সৌভাগ্য হলো। তবে এখানে ছোট বাচ্চাদের ওঠা নিষেধ। মুন রেকার চলতে শুরু করলো। এটা অনেকটা ট্রেনের মতো। সবাই ভয়ে চিৎকার করে। দ্রুতগতিতে চলে মুন রেকার। ওপরে উঠছে, আবার নামছে।

ঘুরতে ঘুরতে গেলাম ওয়াটার কোস্টারের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে ওপরে উঠে পড়ি। এখানে লাইনটা দীর্ঘ নয়। কোস্টারে দুজন করে উঠতে হয়। পানির ওপর দিয়ে কোস্টারে চড়ে নিচে নামতে হয়। তাও আবার খুব দ্রুত। আঁকাবাঁকা প্লাস্টিকের পানিযুক্ত রাস্তা। আমি আর রাকিব একসঙ্গে উঠছি। রাকিব সামনে। কোস্টারটি দ্রুতগতিতে একবার এদিকে আরেকবার অন্যদিকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এবার মনে হয় পড়েই যাবো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওপর থেকে নিচে নেমে আসি। বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু মনে হচ্ছে একটা চ্যালেঞ্জ। আবারও উঠতে ইচ্ছা করছে। একে একে ‘ক্যাটারপিলার’ ও ‘আইসল্যান্ড’ও ঘুরে দেখি।

আনন্দের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। দুপুরের সূর্যটাও মাথার ওপরে এসে গেছে। সবাই ক্লান্ত, কিন্তু এখনও বাকি ওয়াটার ওয়ার্ল্ড। সবচেয়ে মজার জায়গা। এর আগে দুপুরের খাবার খাওয়ার চিন্তা করি। খাবার শেষ হতে না হতেই ঝুমবৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় ছুটে যাই ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডেও অনেকগুলো রাইড। প্রথমে গেলাম মাল্টি-প্লে জোনে। বৃষ্টি ঝরছে আর আমরা পানির ভেতর খেলছি। আবারও মনে হচ্ছিল ফিরে গেছি সেই ১২ কিংবা ১৪ বছর বয়সে সেই ছেলেবেলায়, সেই দুরন্ত জীবনে। ওখান থেকে গেলাম ওয়েব রানারে। চারদিকে মিউজিকের শব্দ। কেউ কেউ রেইন ড্যান্সে নাচানাচি করছে। প্রায় দুই ঘণ্টা পানির সঙ্গে খেলায় মেতেছিলাম। হঠাৎ মাইকে অ্যানায়ুন্স করলো, ওয়েব পুলে ঢেউ তোলা হবে। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে এই ঢেউ। আমরা সবাই ওয়েব পুলে নেমে পড়ি। পাশে মিউমিক বাজছে আর ওয়েব পুলে ঢেউ আছড়ে পড়ছে, ঠিক যেন কুয়াকাটার ঢেউ। সবাই ঢেউয়ের সঙ্গে নাচছেন। আমরা বাদ যাই কীভাবে? হিন্দি, বাংলা, ডিজে, চিৎকার আর ঢেউয়ে একাকার ওয়েব পুল। প্রায় ১৫ মিনিট পর শেষ হয় ঢেউ আর মিউজিক। ওয়াটার ওয়ার্ল্ড থেকে বের হই।

সূর্যটা ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে, কিন্তু আমাদের সব রাইডে চড়া শেষ হয়নি। তিনটি রাইড বাকি ছিল, কিন্তু কিছু করার নেই। ফিরতে হবে গন্তব্যে। সবাই ডাকাডাকি শুরু করেছে গাড়িতে ওঠার জন্য। ওই দিনটি ভুলতে পারবো না। পুরো পরিবার মিলে সময় কাটানোর অনুভূতি ভোলার নয়। এমন সুন্দর সময় উপহার দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই আয়োজকদের।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০