ছোট কোম্পানি নিয়ে বড় খেলা

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: ছোট ছোট কোম্পানি নিয়ে বড় খেলায় মেতেছেন পুঁজিবাজার কারসাজিকারীরা। মূলধন ও শেয়ার কম থাকায় এসব কোম্পানি টার্গেট করছে তারা। এরপর নিজেরা ক’জন মিলে নেমে পড়ছে জুয়া খেলায়। একটু একটু করে বাড়াচ্ছে নিজেদের কাক্সিক্ষত শেয়ারদর। এক সময় উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে বেরিয়ে পড়ছে তারা। এক বছরে অন্তত ২০ কোম্পানির নামে রয়েছে এমন অভিযোগ। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকার কম ও শেয়ার সংখ্যা ৬০ লাখের নিচে রয়েছে এমন কোম্পানিতে কারসাজিকারীদের দৌরাত্ম্য বেশি থাকে। শেয়ার কম থাকায় তারা এসব কোম্পানি নিয়ে সহজেই গেম করতে পারে। তারা কৌশলে অল্প অল্প করে শেয়ার কিনে উল্লিখিত শেয়ার অতিমূল্যায়িত করে ফেলে। টানা দর বৃদ্ধির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ সময় সুবিধাবাদীরা নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে ওই কোম্পানি থেকে বেরিয়ে যায়। ফলে চরম মূল্য দিতে হয় ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীদের।
এক বছরের বাজারচিত্র লক্ষ করলে দেখা যায়, এ সময়ের মধ্যে প্রায় ২০টি স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির রেকর্ড করেছে। এ বছর সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে মুন্নু সিরামিকের। বছরের ব্যবধানে এই শেয়ারদর বেড়েছে ৬৭০ শতাংশ। পরের অবস্থানে রয়েছে মুন্নু জুট স্টাফলার্সের। বর্তমানে পুঁজিবাজারে আলোচনার শীর্ষে রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরের ব্যবধানে মুন্নু স্টাফলার্সের শেয়ারদর বেড়েছে ৬১৫ শতাংশের বেশি। এক বছর আগে এই শেয়ারের দর ছিল ৫০৬ টাকা। গতকাল সর্বশেষ যা লেনদেন হয় তিন হাজার ৬২৪ টাকা ৭০ পয়সায়। এটা বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির সর্বোচ্চ শেয়ারদর।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর মুন্নু স্টাফলার্স শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে। আগের বছর ২০১৬ সালে দিয়েছিল ১০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ২.৯৫ টাকা। কোম্পানিটিতে শেয়ার রয়েছে মাত্র চার লাখ ৬০ হাজার। সূত্র জানায়, এই শেয়ারগুলো কয়েকজন লোকের হাতে রয়েছে। তারাই কারসাজি করে শেয়ারের দর এ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। একই ঘটনা ঘটেছে মুন্নু জুটের বেলায়ও।
এদিকে মুন্নু স্টাফলার্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ থাকায় একটি সিকিউরিটিজ হাউজ ও এর গ্রাহকের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এরই মধ্যে সিকিউরিটিজ হাউজটির কর্মকর্তাদের তথ্যও সংগ্রহ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) পাঠানো এক চিঠিতে কমিশন জানায়, কমার্স ব্যাংক সিকিউরিটিজ, এর কতিপয় গ্রাহক ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, মুন্নু সিরামিক, মুন্নু স্টাফলার্সসহ আরও কিছু কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির বিষয় খতিয়ে দেখবে এ কমিটি।
এদিকে স্টাইলক্র্যাফট, মডার্ন ডায়িং, সোনালী আঁশ, কে অ্যান্ড কিউ, বিডি অটোকারস, আজিজ পাইপসহ আরও কিছু স্বল্পসংখ্যক শেয়ারধারী কোম্পানির শেয়ারের দর অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বছরজুড়েই এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। যদিও প্রমাণের অভাবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে তৎপর বিএসইসি।
এসব কোম্পানির মধ্যে বছরের ব্যবধানে কে অ্যান্ড কিউ’র শেয়ারদর বেড়েছে ৩১০, বিডি অটোকারসের ২৫১, জুট স্পিনার্সের ২৩১, আজিজ পাইপের ১৫৫, ফার্মা এইডের ১৬২, সাভার রিফ্র্যাক্টরিজের ১২, লিবরা ইনফিউশনের ১১৭, শ্যামপুর সুগারের ৯৯ শতাংশ দর বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস, স্টাইলক্র্যাফট, এপেক্স ফুড, সোনালী আঁশ অ্যাম্বি ফার্মা, মডার্ন ডায়িং, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, রেকিট বেনকিজারসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দর বেড়েছে ২০ থেকে ১০০ শতাংশের মধ্যে।
এদিকে যেসব কোম্পানি নিয়ে কারসাজির অভিযোগ রয়েছে, সবগুলোরই শেয়ার সংখ্যা কম। এর মধ্যে স্টাইলক্র্যাফটের ৯ লাখ ৯০ হাজার, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টসের ৯ লাখ ৯৪ হাজার, লিবরা ইনফিউশনের ১২ লাখ ৫২ হাজার, মডার্ন ডায়িংয়ের ১৩ লাখ ৬৮ হাজার, সাভার রিফ্র্যাক্টরিজের ১৩ লাখ ৯৩ হাজার, জুট স্পিনার্সের ১৭ লাখ, রেনউইক যজ্ঞেশ্বরের ২০ লাখ, নর্দান জুটের ২১ লাখ ৪৩ হাজার, অ্যাম্বি ফার্মার ২৪ লাখ, সোনালী আঁশের ২৭ লাখ ১২ হাজার, ফার্মা এইডের ৩১ লাখ ২০ হাজার, জেমিনি সি ফুডের ৩৭ লাখ ১৩ হাজার, বিডি অটোকারসের ৩৮ লাখ ৬৩ হাজার, রেকিট বিনকিজারের ৪৭ লাখ ২৫ হাজার, কে অ্যান্ড কিউর ৪৯ লাখ তিন হাজার, শ্যামপুর সুগারের ৫০ লাখ, আজিজ পাইপের ৫০ লাখ ৯৩ হাজার এবং এপেক্স ফুডের ৫৭ লাখ তিন হাজার শেয়ার রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, বাজারে যারা কারসাজি করে, তাদের নজর থাকে স্বল্প মূলধনি ও কম শেয়ার রয়েছেÑএমন কোম্পানির দিকে। কারণ এসব কোম্পানি অপেক্ষাকৃত কম পুঁজি নিয়ে তারা গেম করতে পারে। আর তাদের ফাঁদে পা দেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সর্বশেষ তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ ব্যাপারে বিএসইসির হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
এদিকে বিষয়টি জানতে বিএসইসিতে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে মাঝেমধ্যে। বিষয়টি আমরাও বুঝতে পারি; কিন্তু পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকায় কিছু করার থাকে না আমাদের।

 

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০