পলাশ শরিফ : প্রতিষ্ঠার ছয় বছরেও বিমা খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ (আইডিআরএ)। ‘উন্নয়ন’-এর বদলে ‘নিয়ন্ত্রণ’ বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় বিপাকে পড়েছে বিমা কোম্পানিগুলো। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বশীলদের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার ঘাটতি ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়াকেই দায়ী করা হচ্ছে। বিমা খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠনের কথা থাকলেও গত ছয় বছরেও তা হয়নি। এ অবস্থায় বিমা খাতের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের আদলে আইডিআরএ’র জন্যও একটি পৃথক পরিচালনা পরিষদ গঠনের তাগিদ দিয়েছেন বিমা বিশ্লেষকরা।
তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে পথচলা শুরুর প্রায় ছয় বছরেও বিমা খাতের শৃঙ্খলা ফেরেনি। এজন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে সঠিক দিকনির্দেশনার ঘাটতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বশীলদের কর্মকাণ্ডের ওপর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ না থাকাকেই দায়ী করা হচ্ছে। বহুল প্রত্যাশিত নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি কার্যত ‘ব্যর্থ’ সংস্থায় পরিণত হয়েছে। এজন্য নীতিমালা ও জনবল সংকটের পাশাপাশি শক্তিশালী উপদেষ্টা কমিটি কিংবা পৃথক পরিচালনা পর্ষদ না থাকাকেই দায়ী করছেন এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথক একটি পরিচালনা পর্ষদ থাকলে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান কিংবা দায়িত্বশীল শীর্ষ কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণও সহজ হবে। সেইসঙ্গে বিমা খাতের উন্নয়নে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া আরও গতিশীল হবে। তবে পৃথক পরিচালনা পরিষদ গঠনের জন্য বিদ্যমান আইন সংশোধন করতে হবে।
এ বিষয়ে আলাপকালে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট মো. আহসানুল ইসলাম টিটু শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ছয় বছরে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ অকার্যকর একটি সংস্থায় পরিণত হয়েছে। এ সংস্থা গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। আমি মনে করি, সংস্থাটির দায়িত্বশীলদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা থাকলে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এমন অবস্থা হতো না। আমার জানামতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির একটি উপদেষ্টা কমিটি করার কথা ছিল। কিন্তু অদ্যাবধি ছয় বছরেও একটি কমিটি হয়নি। এ কারণে আইডিআরএ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র উপদেষ্টা কমিটি গঠন বিষয়ে বিমা আইনের ১৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষ (নিয়ন্ত্রক সংস্থা), সরকারের সহিত আলোচনা সাপেক্ষে, এই আইনের অধীনে তাহার দায়িত্ব পালনে পরামর্শ প্রদানের জন্য প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করিবে এবং উহার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করিবে।’ ওই আইনি নির্দেশনা পরিপালনের জন্য ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর উপদেষ্টা কমিটি বিষয়ে একটি প্রবিধানের চূড়ান্ত গেজেটও প্রকাশ করা হয়। ‘বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (উপদেষ্টা পরিষদ) প্রবিধানমালা’ শিরোনামের এ প্রবিধান মেনে আইডিআরএ’র জন্য ১৫ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠনের কথা ছিল। প্রবিধানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে ওই কমিটির সঙ্গে আলোচনার বাধ্যবাধকতাও রাখা হয়। কিন্তু প্রবিধান প্রণয়নের সাড়ে পাঁচ বছরে নিয়ন্ত্রক সংস্থার জন্য উপদেষ্টা কমিটিই গঠন করা হয়নি।
বিমা খাতের দায়িত্বশীলরা বলছেন, উপদেষ্টা কমিটি না থাকায় গত ছয় বছরে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে গিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। বিমায় শৃঙ্খলা ফেরেনি ছয় বছরেও। এখনও জনবল ও অবকাঠামোসহ আইনি-বিধিমালা সংক্রান্ত দুর্বলতাই কাটিয়ে উঠতে পারেনি আইডিআরএ। সেইসঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে অন্য নিয়ন্ত্রক সঙ্গে সমন্বয়হীনতা, বিমা কোম্পানির উদ্যোক্তা ও স্বতন্ত্র পরিচালক সংখ্যা, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ, জীবন ও সাধারণ বিমার ব্যবস্থাপনা ব্যয় এবং সংস্থাটির জনবল নিয়োগ-পদোন্নতিসহ বেশকিছু ইস্যুতে আইডিআরএ’র ‘বিতর্কিত’ সিদ্ধান্ত বিমা খাতকে উল্টো বিরূপ অবস্থার মধ্যে ফেলেছে। উপদেষ্টা কমিটি না থাকায় সংস্থাটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেও মনে করছেন তারা।
শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানি ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মনজুরুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিমা খাতটি অন্য যে কোনো খাতের তুলনায় অনেক বেশি টেকনিক্যাল। এ খাতের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো স্বল্প সময়ে রপ্ত করা কঠিন। সে কারণেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বটিও বেশ কঠিন। এজন্য একটি শক্তিশালী উপদেষ্টা কমিটির বিকল্প নেই। এতে যে কোনো প্রয়োজনে উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও সহজ হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা অন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার আদলে এ সংস্থার জন্য একটি পৃথক পরিচালনা পর্ষদ গঠনের সুযোগ আছে কি নাÑসেটিও খতিয়ে দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সংস্থাটির সামর্থ্য আরও বাড়বে।’
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বয় সভায় উপদেষ্টা কমিটি গঠন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। ওই সভায় বিমা শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এমন ২৫ থেকে ৩০ জনের নামের তালিকা তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ আকারে পাঠানোর সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল। এরপরেই থমকে গেছে পুরো প্রক্রিয়াটি। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসেবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনকারী এম শেফাক আহমেদ অ্যাকচুয়ারি ‘একচ্ছত্র আধিপত্য’ খর্ব হওয়ার আশঙ্কায় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের দিকে মনোযোগ দেননি। সে কারণে উপদেষ্টা কমিটি গঠনের উদ্যোগ হালে পানি পায়নি।