নানা জটিলতা পেরিয়ে ২০১৪ সালে শুরু হয় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। তবে নির্মাণ শুরুর পরও জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে প্রকল্পটি। এ নিয়ে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে প্রকল্পটির ব্যবস্থাপনা পরামর্শক। তা নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ শেষ পর্ব
ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। আর সেতুটির নকশা প্রণয়ন করা হয় তারও দুই বছর আগে। তবে এখনও সেতুটির পাইলের নকশা নিয়ে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। গত বছর নভেম্বর থেকে চলতি বছর এপ্রিলের মধ্যে দুই দফা পরিবর্তন আনা হয়েছে পাইলের নকশায়। ফলে এখনও চ‚ড়ান্ত নকশা অনুমোদিত হয়নি। এছাড়া দুই দফা পরিবর্তনের পর মাঝনদীতে সেতুর পাইলের গভীরতা কমে গেছে। আর গভীরতা বেশি মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের কাছে থাকা পাইলগুলোর।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরামর্শকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয় রেন্ডাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। এতে সেতুটির নকশা সংশোধনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, পাইলিংয়ের নকশা সংশোধনে গত বছর নভেম্বরে উচ্চ পর্যায়ের (মাইলস্টোন) এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, মাঝনদীতে ১৩ থেকে ২৫নং পিলারের ৭৮টি পাইলের গভীরতা বাড়ানো হবে। আগে পাইলগুলোর গভীরতা ধরা হয়েছে পানির শূন্য ডিগ্রি থেকে ৯৮ মিটার (৩২১ দশমিক ৫২ ফুট)। তবে তা বাড়িয়ে পানির শূন্য ডিগ্রি থেকে ১১৪ মিটার (৩৭৪ ফুট) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে পদ্মা সেতুর সব পিলারের পাইলিংয়ের গভীরতা সমান হতো।
নকশা পরিবর্তনের যুক্তি হিসেবে বলা হয়, পদ্মার মূল চ্যানেল গতিপথ পরিবর্তন করে যদি কোনো কারণে মাওয়া থেকে জাজিরামুখী হয়, তখন নদীর তলদেশের মাটিক্ষয় (স্কাওয়ার) বেড়ে যেতে পারে। আর সে ঝুঁকি কমাতে পাইলের গভীরতা বাড়ানো দরকার। তবে পাইলের গভীরতা বাড়াতে গিয়ে দেখা যায়, ১১৪ মিটার গভীরতায় কাদার স্তর রয়েছে। পরীক্ষামূলক পাইল (টিডি৩বি-১ ও টিডি৩বি-২) নির্মাণের পর তা ধরা পড়ে। ওই মাটি পিলারের ভারবহনে সক্ষম নয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত এপ্রিলে আবার পদ্মা সেতুর নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। এতে ১৩ থেকে ২৫নং পিলারের জন্য ৭৮টি পাইলের গভীরতায় আগের অবস্থা বহাল রাখা হবে। অর্থাৎ মাঝনদীতে সেতুটির পাইলগুলোর গভীরতা হবে ৯৮ মিটার, যদিও মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের কাছে থাকা পিলারের পাইলগুলোর গভীরতা ধরা হয়েছে ১১৪ মিটার। তবে জাজিরা প্রান্তের ৩৭ থেকে ৪১নং পিলারের জন্য পাইলের গভীরতা আরও বেশি। এগুলোর গভীরতা ১২২ মিটার বা ৪০০ ফুট।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, নকশা পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। মাটির গুণাগুণ, নদীর তলদেশের মাটিক্ষয়, স্রোতের ধারা ইত্যাদি বিবেচনা করেই নকশা প্রণয়ন করা হয়েছিল। তবে এ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর ভিত্তিতেই কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১৪টি পিলার ছাড়া বাকিগুলোর নকশা চ‚ড়ান্ত হয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাওয়ার দিকে ৬ থেকে ১২ এবং জাজিরার দিকে ২৬, ২৭, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৫নং পিলারের জন্য পাইলিংয়ের গভীরতা ধরা হয়েছিল পানির শূন্য ডিগ্রি থেকে ১১৪ মিটার। তবে ওই পাইলগুলোর পাইলিংয়ের শেষ প্রান্ত বা তার কাছাকাছি স্থানে কাদার স্তর রয়েছে। ফলে লোড টেস্টে পাইল কাদার ভেতরে দেবে যেতে পারে। এজন্য মে মাসে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে ডিজাইন রিভিউয়ের জন্য ব্যবস্থাপনা পরামর্শক রেন্ডালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এক্ষেত্রে কয়েকটি বিকল্প নিয়ে কাজ করছে রেন্ডাল। এগুলো হলোÑকাদার স্তরের তিন মিটার ওপরে পাইল শেষ করা, মূল নকশা প্রণয়নে ব্রিটেনের স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করা হলেও পরিবর্তিত নকশায় যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ, কোনো পেনিট্রেশন টেস্টের (সিপিটি) পরিবর্তে পাইজোকোন পেনিট্রেশন টেস্ট (পিসিপিটি) অনুসরণ এবং দুটি পরীক্ষামূলক পাইল নির্মাণ করে সেগুলোর বহুমাত্রিক টেস্ট।
তথ্যমতে, চলতি মাসে পাইলের নকশা চ‚ড়ান্ত করতে উচ্চ পর্যায়ের আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৪টি পিলারের পাইলগুলোর গভীরতা ১০ মিটার কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ছয়টির পরিবর্তে সাতটি পাইল করা হবে। তবে এখনও নকশা চ‚ড়ান্ত করা যায়নি, যদিও চলতি মাসের মধ্যে পাইলগুলোর নকশা চ‚ড়ান্ত করার কথা ছিল।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের সময় ঘাটতি ছিল। প্রতিটি পিলারের গোড়ার মাটি পরীক্ষা করা হয়নি। পাঁচটির পরপর একটি করে পিলারের মাটি পরীক্ষা করা হয়, আবার তুলনামূলক কম গভীর মাটি পরীক্ষা করা হয়। ৭০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মাটি পরীক্ষা করা হয়। ফলে এর নিচে মাটির কী অবস্থা রয়েছে তা জানা যায়নি। এতে পাইল করতে গিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
যদিও এর সঙ্গে একমত নন পদ্মা সেতুর প্যানেল অব এক্সপার্টের সদস্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি বলেন, পদ্মা নদীর তলদেশ থেকে প্রতি বছর কিছুটা করে মাটি সরে যায়। খরস্রোতের কারণে এমনটি হয়। তাই পদ্মা সেতুর পাইল অনেক গভীর করা হচ্ছে। বিশ্বে কোনো সেতুতে এত গভীর পাইল করতে হয়নি। তবে এখন পাইলের শেষ প্রান্তে কাদা-মাটির স্তর ধরা পড়ায় দেখা দিয়েছে নতুন জটিলতা। এতে নকশা প্রণয়নে কোনো সমস্যা ছিল না। এছাড়া সব ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট স্থান পরপর মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে নকশা প্রণয়ন করা হয়।
তিনি আরও বলেন, যমুনা সেতুর ক্ষেত্রেও পাঁচটি পিলারের পর একটি করে পিলারের নিচের মাটি পরীক্ষা করা হয়েছিল। এছাড়া যমুনা সেতু ডিজাইন বিল্ট ছিল। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক তথ্যের ভিত্তিতে এর ডিজাইন করা হয়। পরে তার ভিত্তিতে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল। সেটিতে কোনো সমস্যা হয়নি। এছাড়া পদ্মা সেতুর ডিজাইন প্রণয়ন করে বিশ্বখ্যাত দুই কোম্পানি মনসেল-এইকম। তাই পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে ডিজাইন ত্রæটির কোনো প্রশ্ন আসে না।
Add Comment