জনতা-অগ্রণীর প্রভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি আরও বেড়েছে

রোহান রাজিব: রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়েছে। গত জানুয়ারি-মার্চ; তিন মাসে এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। আর গত এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের শীর্ষ রয়েছে জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক। এই দুই ব্যাংকে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ। সার্বিকভাবে এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য এই দুই ব্যাংকই দায়ী। এক বছরের মধ্যে এই দুই ব্যাংকে যেভাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, তা অন্যান্য ব্যাংকে তুলনামূলক কম। ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বেশিরভাগই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠজনরা নিয়েছেন। তাই এসব ঋণ আদায় হচ্ছে না। তাই দিন দিন এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এসব ঋণ আদায়ে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ থেকে মুক্তি পাবে না। রাজনৈতিক কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে থাকলে ভবিষ্যতে খেলাপি বাড়তেই থাকবে।

তথ্যে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগের চেয়ে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। তিন মাস আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৭৯ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। তিন মাসে বেড়েছে ৬ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। আর ২০২৩ সালের মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৬০ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার ২২৮ কোটি টাকা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত তিন মাসে সোনালী, জনতা, রূপালী এবং বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এ সময় অগ্রণী ও বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ কমেছে। তবে এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ছাড়া বাকি পাঁচটি ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের শীর্ষে জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক। এ খাতের ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের ৬০ শতাংশই এই দুই ব্যাংকে। তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ৩১ শতাংশ। তিন মাসে আগে অর্থাৎ গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৯ কোটি টাকা। তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। আর গত বছরের মার্চে খেলাপি ছিল ১৫ হাজার ৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল জব্বারকে ফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।

দ্বিতীয় স্থানে থাকা অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এ বছরের মার্চ পর্যন্ত কিছুটা কমেছে। মার্চ শেষে  ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ২৮ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ২১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। তিন মাসে খেলাপি কমেছে ৬১২ কোটি টাকা। তবে বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। গত বছরের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ১৪ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা।

একই বিষয় জানতে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুরশেদুল কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের এ বছরের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে যা ছিল ১৩ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। আর গত বছরের মার্চে ছিল ১২ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৩৪০ কোটি এবং বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা।

এ খাতের রূপালী ব্যাংকের এ বছরের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ১০ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। আর গত বছরের মার্চ শেষে ছিল ১০ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। তিন মাসে এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩১৪ কোটি টাকা এবং এক বছরের ব্যবধানে ১৩০ কোটি টাকা বেড়েছে।

এছাড়া সংকটে থাকা বেসিক ব্যাংকের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৮ হাজার ২৯২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৩ শতাংশ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। আর গত বছরের মার্চ পর্যন্ত ছিল ৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮৮ কোটি এবং এক বছরের ব্যবধানে ৮১৭ কোটি টাকা বেড়েছে।

এ বছরের মার্চ শেষে বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮৯৪ কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ৯৯৩ কোটি টাকা। আর গত বছরের মার্চ শেষে ছিল ১ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। তিন মাসে বিডিবিএলের খেলাপি কমেছে ১১৯ কোটি এবং বছরের ব্যবধানে কমেছে ১৮৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সরকারের সদিচ্ছা যদি থাকে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যদি শক্ত অবস্থান নেয়, তাহলেই খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে বলে দেয়, খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারলে পারফরম্যান্স নেতিবাচক ধরে সব রকম সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হবে। তাহলেই খেলাপি ঋণ আদায় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো ঋণখেলাপিদের আরও ছাড় দেয়া, সময় বাড়িয়ে দেয়া, সহজ শর্তে পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে।’

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০