Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 11:17 am

জনতা ব্যাংকের আবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সায়

শেখ আবু তালেব: রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল অ্যানন টেক্স। ঋণ গ্রহণের পুরো প্রক্রিয়াই ছিল দুর্নীতিতে ভরা। ঋণ দেয়ার সব ধরনের শর্তকে উপেক্ষা করেই এসব ঋণ দেয়া হয়। সেই ঋণ পরবর্তীকালে খেলাপিতে পরিণত হয়। একক গ্রাহকসীমা লঙ্ঘন করে এসব ঋণ দেয়া হয়। তবে খেলাপি হওয়া সেই ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এতে খেলাপি হওয়া তিন হাজার ৭৪২ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত হচ্ছে অ্যানন টেক্স গ্রুপের। গতকাল এ বিষয়ে জনতা ব্যাংককে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। এর ফলে জনতা ব্যাংক এখন এসব ঋণকে নিয়মিত দেখাতে পারবে। এর বিপরীতে থাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতিকে (প্রভিশন) মূল আয়ে নিতে পারবে জনতা ব্যাংক। ফলে জনতা ব্যাংকের লোকসানের অঙ্ক কমে যাবে।

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. এসএম মাহফুজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি হওয়া ঋণখেলাপিরা পুনঃতফসিল করতে পারে। অ্যানন টেক্স সেই সুবিধা চেয়েছে। আমরা প্রস্তাবটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠিয়েছি অনুমোদনের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে ঋণটি পুনঃতফসিল হবে। কিন্তু পুনঃতফসিলের শর্তাবলি লঙ্ঘন করলে সব সুবিধা বাতিল হবে। ঋণের দায় ও চলমান মামলা থেকে কিন্তু অ্যানন টেক্স রেহাই পাবে না। প্রতিষ্ঠানটিকে সব দায় পরিশোধ করতে হবে।’

অবশ্য ঋণ পুনঃতফসিলের বেলায় বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বিদ্যমান ঋণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত অ্যানন টেক্স নতুন করে কোনো ঋণ নিতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি হওয়া কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন করে ঋণ নিতে পারবে না। কিন্তু ঋণ পুনঃতফসিল বা অন্য কোনোভাবে নিয়মিত করতে পারলে নতুন করে ঋণ পাবে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অ্যানন টেক্স পুরোনো ঋণ পরিশোধ করার আগ পর্যন্ত নতুন ঋণ পাবে না।

জানা গেছে, তিন হাজার ৭৪২ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করতে অ্যানন টেক্সকে দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হবে। এর পরিমাণ হচ্ছে ৮৬ কোটি টাকা। গ্রুপের ১৬টি প্রতিষ্ঠান এর ফলে ঋণ নিয়মিত করার আওতায় চলে আসবে।

জানা গেছে, ঋণ আদায়ের সুবিধার্থে অ্যানন টেক্সের খেলাপি হওয়া ঋণগুলো নিয়মিত করার সুযোগ দেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে জনতা ব্যাংক। এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের যুক্তি হলো, খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠান বৈদেশিকসহ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করতে পারছে না। পণ্য রপ্তানিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এসব বিবেচনায় ঋণগুলো পুনঃতফসিল করতে চায় জনতা ব্যাংক।

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এক অ্যানন টেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণের কারণে জনতা ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। এর খেলাপি হওয়া ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়েছে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে জনতা ব্যাংকের মূলধন কাঠামো। এসব বিবেচনায় জনতা ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিলের পক্ষে গেছে।

যদিও অ্যানন টেক্সের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় অর্থপাচারের বিষয়টি তদন্ত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে এ বিষয়ে একাধিক প্রমাণও পেয়েছে কেন্ত্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে, ২০১৮ সালের এক তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পায়, ২২টি প্রতিষ্ঠানের নেয়া ঋণের অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে এবং ঋণ গ্রহণে জালিয়াতি ও আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে।

ঋণ নিয়মিত করতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জনতা ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছিল অ্যানন টেক্স। প্রসঙ্গত, ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে অ্যাননটেক্স গ্রুপের ২২টি কোম্পানিকে জনতা ব্যাংক তিন হাজার ৫২৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা ঋণ দেয়। এসব ঋণ দিতে ব্যাংকের একক গ্রাহকসীমা লঙ্ঘন করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ কোনো একক গ্রাহককে দিতে পারে না। কিন্তু এসব ঋণ দেয়া হয়েছে দুর্নীতির মাধ্যমে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রুপটির মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৫২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হচ্ছেÑলামিসা স্পিনিং, ইয়ার্ন ডায়িং, জুভেনিল সোয়েটার্স, সিমি নেট টেক্স, সুপ্রভ কম্পোজিট, এফকে নিট, সিমরান কম্পোজিট, জারা নিট টেক্স, গ্যাট নিট টেক্স, জেওয়াইবি নিট টেক্স, এম এইচ গোল্ডেন জুট, জ্যাকার্ড নিট টেক্স, স্ট্রাইগার কম্পোজিট, আলভি নিট টেক্স, এম নুর সোয়েটার্স, গ্যালাক্সি সোয়েটার, জারা লেভেল অ্যান্ড প্যাকেজিং, সুপ্রভ মিলাঞ্জ স্পিনিং, শাইনিং নিট টেক্স, জারা ডেনিম ও সুপ্রভ রোটর স্পিনিং।

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ গতকাল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি বর্তমানে ঢাকার বাইরে আছি। অ্যানন টেক্সের ঋণ পুনঃতফসিলের চিঠি এখনও হাতে পাইনি। ঢাকায় গেলে বলতে পারব।’